পাহাড়ের পার্শ্বঢাল রক্ষায় বিন্না বা ভেটিভার ঘাসের জুড়ি নেই। তাই প্রকৃতিতে অনেকটা অনাদরে জন্ম নিলেও এই ঘাসের খ্যাতি ও কদর বিশ্বজোড়া। বিভিন্ন দেশে পাহাড়ের ক্ষয়রোধ ও পাহাড়ধস বন্ধে পার্শ্বঢালে এই জাদুকরী ঘাস লাগানো হয়। কারণ বিন্না ঘাসের মূল গভীরে চলে গিয়ে মাটিকে শক্ত করে আঁকড়ে রাখে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের অনেক পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবেই সৃষ্ট এমন ঘাস দেখা যায়। তারপরও বন্দর নগরী চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর ক্ষয়রোধ ও ধস ঠেকাতে থাইল্যান্ড থেকে ২৮ লাখ টাকা খরচ করে প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর আগে নিয়ে আসা হয় বিদেশি জাতের বিন্না ঘাস।

নগরীর টাইগারপাস ও লালখান বাজারের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত বাটালি হিলের মিঠাপাহাড়ের পাদদেশে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে এই ঘাস লাগানোও হয়। থাইল্যান্ডের রাজকন্যা

মহাচক্রি শিরীন ধরনকে দিয়ে উদ্বোধন করা হয়েছিল বিন্না ঘাস লাগানো প্রকল্পের কার্যক্রম। কিন্তু এতটুকুই, যে পাহাড়ে বিন্না ঘাস লাগানো হয়েছিল, সেখান থেকে আর অন্য কোনো পাহাড়ে নেওয়া যায়নি এই জাদুর ঘাস।

বিশিষ্টজনরা বলছেন, নির্বিচারে পাহাড় কাটা, গাছপালা ও লতাগুল্ম কেটে সাফ করে ফেলার ফল এখন চট্টগ্রামের মানুষ হাতেনাতে পাচ্ছে। বর্ষা মৌসুম তো বটেই, মাঝারি কিংবা ভারী বৃষ্টিপাত হলেই ঘটছে পাহাড়ধসের মতো ঘটনা। আবার পাহাড়গুলো বেলে মাটির হওয়ায় মাটি ও বালু ক্ষয়েও ঘটছে দুর্ঘটনা; হচ্ছে প্রাণ ও সম্পদহানি। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষয়িষ্ণু পাহাড়ের ঢালে ব্যাপক হারে বিন্না ঘাস লাগানো গেলে ধস ঠেকানো যেত বলে গবেষকরা মনে করেন। ঢাকঢোল পিটিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নগরীর পাহাড়গুলোতে এই ঘাস লাগানোর প্রকল্প শুরু করলেও সমন্বয় এবং তদারকির অভাবে শুরুতেই তা মুখ থুবড়ে পড়েছে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বিন্নাকে পাহাড় রক্ষার জাদুর ঘাস বলা হয়। কারণ এর লম্বা শিকড় অল্প দিনেই মাটির নিচে জালের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় শিকড় চলে যায় ১০ থেকে ১৪ ফুট পর্যন্ত গভীরে। গবেষণায় দেখা গেছে, চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে মাটিতে বোনা ঘাস ঢাল রক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। আবার শীত বা গ্রীষ্ম সব মৌসুমে টিকে থাকতে পারে এই ঘাস। পানি পরিষ্কার করতে এবং পানি থেকে আর্সেনিক দূর করে দূষণ কমাতেও এ ঘাস কার্যকর ভূমিকা রাখে। আবার শুকনা ঘাস দিয়ে তৈরি করা যায় পাটি ও ঘরের ছাউনি।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের মে মাসে বিন্না ঘাস লাগানোর কার্যক্রম উদ্বোধনকালে তৎকালীন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রকল্পের জন্য ২ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরে সে অর্থ আর ছাড় হয়নি। ফলে প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে। সম্প্রতি মিঠাপাহাড়ের পাদদেশে সরেজমিন ঘুরে, এই ঘাসের যত্ন নেওয়ার মতো কাউকে পাওয়াও যায়নি। ঘাস বড় হলে তার উপরিভাগ ছেঁটে না দিলেও নিয়মিত পানি দিতে হয়। কিন্তু ছেঁটে দেওয়া তো দূর থাক, কবে শেষ পানি দেওয়া হয়েছে, তাও বলতে পারেননি সিটি করপোরেশনের কেউ।

প্রকল্প শুরুর সময় পাহাড়ের পাদদেশে নির্মাণ করা হয় ভেটিভার সেন্টার। স্থাপন করা হয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার নানা যন্ত্রপাতি, খোলা হয় কার্যালয়। পাশেই বিন্না ঘাসের প্লট ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র শেড।

এখন সব অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রশিক্ষণ শেডটি সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগের মশকনিধনে ব্যবহৃত কালো তেল রাখার গুদামে পরিণত করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, নগরীর পাহাড়গুলোয় বিন্না ঘাস রোপণ প্রকল্পের ব্যাপারে এখন চসিকের কারও আগ্রহ নেই। এরই মধ্যে পাল্টেছেন মেয়র এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। ফলে নতুন করে প্রকল্পটি চালুর বিষয়ে আর মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেননি চসিকের কেউ। তবে বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলছেন, তিনি নিজে পাহাড় রক্ষায় বিন্না ঘাস নিয়ে আগ্রহী।

তিনি বলেন, ‘বিন্না ঘাস পাহাড়ের মাটির ক্ষয়রোধ করে। তাই এই ঘাস চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে লাগানো গেলে উপকার পাওয়া যেত। কিন্তু আমরা পাহাড়গুলো রক্ষা করতে পারছি না। অনেক পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। তাই পাহাড় কাটা যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে এই ঘাস কোথায় লাগাব? এই ঘাস লাগানো প্রকল্পে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের একটি অর্থ ছাড়ের কথা ছিল। সেটিও হয়নি।’

বিষয় : পাহাড়ধস রোধ বিন্না ঘাস প্রকল্প

মন্তব্য করুন