- সারাদেশ
- সুদ নিয়ে বিপর্যস্ত একটি পরিবার
সুদ নিয়ে বিপর্যস্ত একটি পরিবার

নিজের জরাজীর্ণ টিনের ঘরের সামনে ছেলের সঙ্গে নাছিমা বেগম - সমকাল
২০১৭ সালে সুদে ৩০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন হতদরিদ্র আতিকুর রহমান। এরপর পর্যায়ক্রমে দুই বছরে প্রায় দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন। তারপরও শোধ হয়নি সুদে কারবারিদের টাকা। শেষে ‘সুদে কারবারিদের দেওয়া বিষ’ পান করে আত্মহত্যা করেন আতিকুর– এমন অভিযোগ তাঁর পরিবারের। এখানেই শেষ নয়, টাকার জন্য তাঁর স্ত্রীকে হুমকিসহ নানাভাবে নির্যাতন করছেন অভিযুক্তরা।
যদিও অভিযুক্তদের দাবি, জমি লিজের টাকা নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। তবে গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বললে তারাও সুদে টাকা দেওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন। বিপর্যস্ত পরিবারটি গত শনিবার কালীগঞ্জ প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে। এ সময় আতিকুরের স্ত্রী নাছিমা বেগমের সঙ্গে ছোট দুই সন্তান মিম ও রাহুল উপস্থিত ছিল। তাদের বাড়ি উপজেলার কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়নের নিত্যানন্দি গ্রামে।
অভাবের সংসারে প্রয়োজন মেটাতে ২০১৭ সালে স্বামী আতিকুর একই গ্রামের মৃত অন্তোষ আলীর স্ত্রী রাবেয়া বেগমের কাছ থেকে মাসিক ৫ হাজার টাকা সুদে ৩০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন বলে জানান নাছিমা। তাঁর ভাষ্য, স্বামী দু’বছরে টাকা এবং সুদের ওপরও সুদ দিতে দিতে প্রায় দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন। তারপরও শোধ হয়নি ৩০ হাজার টাকা। ২০১৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাবেয়া টাকার জন্য তাঁর স্বামীকে ডেকে নিয়ে মারধর ও গালাগাল করেন। পরদিন তাঁর ছেলে আব্বাসসহ তিন-চারজন বাড়িতে এসে আতিকুরকে গালাগাল করেন।
নাছিমার অভিযোগ, একপর্যায়ে তারা আতিকুরকে বলেন, ‘তুই ঘরজামাই হয়ে শ্বশুরবাড়ি পড়ে আছিস। সুদের টাকা দিতে পারিস না। তোদের বিষ খেয়ে মরা উচিত।’ এ কথা বলে আব্বাস একটি বিষের বোতল তাঁর স্বামীর হাতে দিয়ে বলেন, ‘তুই বিষ খেয়ে মর, আমরা দেখি।’ লজ্জা ও অপমান সইতে না পেরে তিনি বিষপান করেন। পরে বাড়ি ফিরে স্বামীকে বারবাজার ক্লিনিকে ভর্তি করলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
ঘটনার পর কালীগঞ্জ থানায় মামলা করতে না পেরে আদালতে চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সে মামলা চলছে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে অভিযুক্তরা হুমকি ও নানাভাবে নির্যাতন করছে পরিবারটিকে। নাছিমা বলেন, তাঁর স্বামী রংমিস্ত্রির সহকারীর কাজ করতেন। সুদে কারবারিদের প্ররোচনায় তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই তিনি পরের বাড়িতে ও মাঠে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। সন্তানদের নিয়ে বেশ কষ্টে আছেন। অভাবের তাড়নায় ১১ বছরের মেয়েকে পরের বাড়িতে কাজে দিয়েছেন।
নিজেদের থাকার কোনো জায়গা নেই পরিবারটির। সরকারি জমিতে ঘর তৈরি করে থাকেন। মামলার আসামিরা তাদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন বলে অভিযোগ নাছিমার। তিনি বলেন, রাতে ঘরের ওপর ইট-পাটকেল ছোড়ে, দরজা খোলার চেষ্টা করে। আব্বাস বলে বেড়াচ্ছেন, স্বামীর পর তাঁকেও শেষ করে দেবেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে সোমবার দুপুরে রাবেয়া ও তাঁর ছেলে আব্বাসের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। এ সময় আব্বাসের মোবাইল ফোনে কল দিলে আদালতে আছে বলে জানান। তিনি সুদে কারবারির বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, তাঁর মায়ের কাছ থেকে জমি লিজের টাকা বাবদ স্ট্যাম্প করে নিয়েছিল নাছিমার পরিবার। সে টাকা শোধ নিয়ে মা ও তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। নাছিমার স্বামীর বিষপানে আত্মহত্যার দিন তাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা স্বীকার করলেও বিষের বোতল দেওয়া বা প্ররোচনার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
নাছিমার প্রতিবেশী পান্না বেগম ও মো. হানজালা জানান, আব্বাসের পরিবার গ্রামের মানুষের কাছে লাভে টাকা-পয়সা লেনদেন করে। এমন ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিষপানে নাছিমার স্বামী মারা গিয়েছিলেন বলে শুনেছেন। তিনি তাঁর সন্তান নিয়ে কষ্টে আছেন। সুদে কারবারিদের বিচার হোক, তারাও চান।
কালীগঞ্জ থানার ওসি মাহবুবুর রহমান জানান, ঘটনাটি জানতে পেরে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইউএনও ইসরাত জাহান বলেন, আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় সুদে কারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত আছে। যদি কেউ তাদের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তারা অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেবেন।
মন্তব্য করুন