পারিবারিক কলহ নিরসনের সালিশে ইদ্রিস আলী নামে বৃদ্ধকে জুতাপেটা করা হয়েছে। করা হয়েছে ৬ লাখ টাকা জরিমানা। ঘাটাইল উপজেলার ধলাপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলামের উপস্থিতিতে গত ২৯ আগস্ট গ্রাম্য সালিশে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার বিচার চেয়ে ১০ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছেন ভুক্তভোগী। দিনকয়েক আগে তাঁর আবেদনের একটি কপি সমকাল প্রতিবেদকের কাছে আসে। একই সঙ্গে আসে সালিশে মারধরের ভিডিও।

আবেদনপত্র থেকে জানা গেছে, রসুলপুর ইউনিয়নের একটি গ্রামের ইদ্রিস আলীর ছেলের সঙ্গে প্রায় ছয় বছর আগে বিয়ে হয় ধলাপাড়া ইউনিয়নের এক তরুণীর। বিয়ের তিন মাস পর সৌদি আরবে পাড়ি জমান তাঁর ছেলে। আট মাস আগে দেশে এসে তিন মাস ছুটি কাটিয়ে ফের সৌদি চলে গেছেন তিনি। এর পরই উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন শুরু করেন পুত্রবধূ (২৩)। শ্বশুর ইদ্রিস আলী এর প্রতিবাদ করলে শুরু হয় বিবাদ। এই কলহ মীমাংসা করতে ২৯ আগস্ট তরুণীর বাবার বাড়িতে বসে সালিশ বৈঠক।

ইদ্রিস আলীর ভাষ্য, সালিশ শুরু হলে তাঁকে অভিযোগ পেশ করতে বলেন মাতবররা। তখন তিনি বলেন, ‘ছেলে বিদেশ থাকে। তবে আমার বাড়িতেই থাকে পুত্রবধূ। কিন্তু তার জীবনযাপন উচ্ছৃঙ্খল। কথা শোনে না। খালি আমারি দোষ?’ ছেলের বউকে নিয়ে এসব অভিযোগ করায় উত্তেজিত হয়ে ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, “পুরান কথা বাদ দিয়ে নতুন কথা ‘ক’।” এরপর অভিযোগ শোনার জন্য তাঁর ছেলের বউকে ডাকেন মাতবররা। তখন তিনি বলেন, তাঁর শ্বশুরের চরিত্র খারাপ। ইদ্রিস জানান, ছেলের বউয়ের এমন বক্তব্যে উপস্থিত আশরাফ আলী নামে একজন তাঁকে গালি দিয়ে বলেন, ‘এহনো বইয়া আছো? মুরুব্বিগো কাছে মাফ চাও।’
আশরাফের কথামতো খসরু হাজি নামে একজনের পা ধরে মাফ চাইতে যান ইদ্রিস আলী। এ সময় তাঁকে লাথি মেরে ফেলে দেন খসরু হাজি। তবে খসরু হাজির ভাষ্য, ইদ্রিস মাফ
চাইতে এলে হাত দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। লাথি দেওয়া হয়নি।

ইদ্রিস আলীর অভিযোগ, চেয়ারম্যান সে সময় বলে ওঠেন ‘শুধু মাফ চাইলেই হবে না। ওকে মারও দিতে হবে।’ এ কথা শোনার পর জুতা দিয়ে পেটাতে শুরু করেন ইউপি সদস্য নূরুল ইসলাম। তবে জুতাপেটার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নূরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ইদ্রিসের পুত্রবধূর বাবার বাড়ি এলাকায় সালিশের আয়োজন করা হয়েছিল। ওই সময় এলাকার মানুষ উত্তেজিত ছিল। তাই ইদ্রিসকে সেভ (বাঁচাতে) করার জন্য জুতা দিয়ে মারতে গিয়েছিলাম।’ বৃদ্ধ ইদ্রিস আলীর পিঠে জুতাপেটার দৃশ্য মোবাইল ক্যামেরায় গোপনে ধারণ করেন কেউ একজন। ভিডিওতে দেখা যায়, ইদ্রিস আলীর পিঠে জুতা দিয়ে পেটাচ্ছেন নূরুল ইসলাম।
ইদ্রিস আলী (৬৫) বলেন, ‘সালিশে সিদ্ধান্ত হয় একতরফা। ছেলের বউ আর সংসার করবে না। সে মোতাবেক উপস্থিত চেয়ারম্যানসহ মাতবররা বিয়ের কাবিনসহ অন্যান্য খরচ বাবদ আমাকে ৬ লাখ টাকা পরিশোধ করতে বলেন। সময় দেওয়া হয় ১৩ দিন। বেঁধে দেওয়া সময় পার হয়ে যাওয়ায় টাকার জন্য ফোন করে এখন হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’

কথা হয় ইদ্রিস আলীর ছেলে বউয়ের সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, তাঁর স্বামী বিদেশ চলে যাওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা তাঁর ওপর বিভিন্ন কারণে অমানবিক নির্যাতন শুরু করে। এসব কারণেই ২৯ আগস্ট চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে সালিশের আয়োজন করা হয়।

ধলাপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম বলেন, তাঁর গ্রামে সালিশের আয়োজন করায় উপস্থিত ছিলেন তিনি। জুতাপেটা করেছেন নূরুল ইসলাম মেম্বার। তিনি ফেরানোর চেষ্টা করেছেন। সালিশে ৬ লাখ টাকা জরিমানা করা যায় কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদে বিচার দিলে সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান আছে। কিন্তু ঘরোয়াভাবে সালিশ হলে মাতবররা বেশি জরিমানা করতে পারেন।’

টাঙ্গাইল জজকোর্টের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি এস আকবর খান জানান, গ্রাম্য সালিশে কেউ জুতাপেটা করতে পারেন না। এ অন্যায়। ৬ লাখ টাকা জরিমানা করাও এখতিয়ারবহির্ভূত। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী ইচ্ছা করলে মানহানির মামলা করতে পারেন।

ঘাটাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ লোকমান হোসেন বলেন, বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছেন তিনি। তবে লিখিত অভিযোগ দেননি কেউ।