ক্ষমতার পালাবদলে খালে নতুন দখলদারের পা

সুমন চৌধুরী, বরিশাল
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
বরিশাল নগরীতে একসময় ২৪টি খাল থাকলেও এখন আছে সাতটি। এর মধ্যে অন্যতম লাকুটিয়া খাল। নগরের মড়কখোলা পুল থেকে শুরু হওয়া সাত কিলোমিটার দীর্ঘ খালের অন্য প্রান্ত মিশেছে বাবুগঞ্জ উপজেলার আড়িয়াল খাঁ ও সন্ধ্যা নদীতে। বরিশাল সিটি করপোরেশনের সীমানার মধ্যে পড়েছে খালের তিন কিলোমিটার। এই তিন কিলোমিটারে রয়েছে দেড় শতাধিক দখলদার। স্থাপনা তৈরি করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দেওয়া তাদের কাজ। গত জুনে সিটি নির্বাচনের পর নগর রাজনীতিতে ক্ষমতার পালা বদলে কমে গেছে পুরোনো দখলদারদের আনাগোনা। পা পড়েছে নতুন দখলদারের। সাম্প্রতিক সময়ে ১২টি স্থাপনা উঠেছে খালের ওপর। সংগঠনের নামেও ঘর তুলে খাল দখল করা হচ্ছে। মঙ্গলবার সরেজমিন ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।
মড়কখোলার পুল নগরের অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা। এখানেই জেল খাল ও লাকুটিয়া খালের মিলনমুখ। নগরী থেকে বাবুগঞ্জ উপজেলা সদরে যাওয়ার উত্তরমুখী ১৮ ফুট প্রশস্ত সড়কটি লাকুটিয়া সড়ক নামে পরিচিত। সড়কের পূর্বপাশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া খালটির নামও লাকুটিয়া। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নগরের সীমানার মধ্যে থাকা ৩ কিলোমিটার কচুরিপানায় ভরা মজা খালে পরিণত হয়েছে সেটি। এর পরের অংশে এখনও প্রবহমান জোয়ার-ভাটা।
সরেজমিন দেখা গেছে, বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ায় নগরের মড়কখোলার পুল থেকেই দখলের শুরু। পুল ঘেঁষে খালে স্থাপিত প্রথম দুটি দোকানের একটি ভাতের হোটেল, অন্যটি চায়ের দোকান। পরের তিনটি দোকানঘরের চকচকে নতুন টিন দেখে বোঝা যায় সম্প্রতি ঘরগুলো তোলা হয়েছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথম ঘর দুটি তোলা হয় বছরখানেক আগে। সিটি নির্বাচনের পরই তোলা হয় অন্য তিনটি ঘর। ঘর দুটির মালিক সবুজ ও কাওছার সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর সমর্থক হিসেবে পরিচিত। সাড়ে ৩ হাজার টাকা করে প্রতিটি ঘর ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। অন্য তিনটি ঘর উত্তোলনকারীরা সর্বশেষ সিটি নির্বাচনে নৌকারকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। এর মধ্যে একটি ঘরে বরিশাল জেলা অটো টেম্পো আলফা, মাহিদ্রা ট্যাক্সিক্যাব, মিশুক, এলপিজি সিএনজি ও থ্রিহুইলার চালক শ্রমিক ইউনিয়নের সাইনবোর্ড সাঁটানো হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, টেম্পো খলিল নামে একজন ঘরটি তুলেছেন। অন্য দুটি ঘরের মালিক বেল্লাল ও মিজু।
মড়কখোলার পুল থেকে নগরের শেষ সীমানা মহামায়ার পুল পর্যন্ত ১২টি চকচকে টিনশেড ঘর দেখা গেছে। আগের অবৈধ স্থাপনার মাঝে ফাঁকা জায়গায় নতুন ঘরগুলো তোলা হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, মালিক-শ্রমিক ইউনিয়নের ঘর তুলেছেন খলিলুর রহমান নামে একজন, যিনি এলাকায় ‘টেম্পো খলিল’ নামে পরিচিত। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘর তুলেছে ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ। মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দুলাল এ বিষয়ে জানেন। তবে দুলাল বলেন, আগে অন্যরা ঘর তোলার পর শ্রমিকরা তাদের ঘরটি তুলেছেন। পাশের দোকানি অনিমেষ জানান, তিনি নিজেই ঘর তুলেছেন। কারও অনুমতি নেননি। যদি সবাই সরিয়ে নেই, তখন তারটাও ভাঙবেন।
এলাকাটি সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডভুক্ত। সেখানকার নবনির্বাচিত কাউন্সিলর আউয়াল মোল্লা সমকালকে বলেন, সিটি নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরই ঘর তোলার হিড়িক পড়ে। তখন কাউন্সিলর না হয়েও আমি মৌখিকভাবে অনেককে নিষেধ করেছি। কেউ মানেনি।
বরিশাল নদী-খাল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, নগরীর খালগুলো রক্ষায় কেউ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। যে কারণে অরক্ষিত খাল যে যার মতো দখল করে নিয়েছে। সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন অযোগ্য একটি প্রকল্প মন্ত্রাণালয়ে দিয়েছিল, যা আলোর মুখ দেখেনি।
পরিবেশ আন্দোলন বরিশালের সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, লাকুটিয়াসহ কোনো খালেরই প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ হয়নি। যে কারণে খালের জমি দখল হচ্ছে। আগে খালের মুখ ৩০ ফুট প্রশস্ত ছিল। এখন সেটা অর্ধেকও নেই। তিনি বলেন, লাকুটিয়া খালে কয়েক বছর আগে দেড় শতাধিক অবৈধ দখলদারের তালিকা করেছিলেন। কোনো দখলদারই উচ্ছেদ হয়নি। নগর রাজনীতির পট পরিবর্তনে নতুন করে খাল দখল শুরু হয়েছে। এখনই এদের দমন করা না গেলে সব দখল হয়ে যাবে।
- বিষয় :
- খাল দখল
- বরিশাল সিটি করপোরেশন