ঢাকা সোমবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৩

চিকিৎসকের ৩৭ পদে শূন্য ৩০

চিকিৎসকের ৩৭ পদে শূন্য ৩০

মাজহারুল আলম মিলন, পীরগঞ্জ (রংপুর)

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

জ্বর, বমি, পেট ব্যথাসহ নানা উপসর্গ নিয়ে কয়েক দিন আগে পীরগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন আরাজী গঙ্গারামপুরের রানা খান। তিনি জানান, শয্যার চেয়ে রোগী বেশি। সকালে-বিকেলে এক চিকিৎসক ছাড়া কাউকে দেখেননি। হাসানপুরের আব্দুল হাকিম মাসখানেক ধরে সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত। তিনি আউটডোরে টিকিট কেটে করে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর চিকিৎসকের দেখা পেয়েছেন।

পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসকের অভাবে রানা ও আব্দুল হাকিমের মতো সেবা পেতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন এলাকার মানুষ। ২০১১ সালে ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। আসবাবসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতিও সরবরাহ করা হয়েছে। তখন নিয়োগ দেওয়া হয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তবে এখন জনবল সংকটসহ নানা কারণে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে।

জানা গেছে, শুরুর দিকে গাইনি বিশেষজ্ঞ যোগদানের পর সিজার অপারেশন হতো। তবে কয়েকটি সিজারের পর ১৩ বছর ধরে তা বন্ধ রয়েছে। ফলে প্রসূতিরা এ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এক সময় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স জরুরি প্রসূতি সেবা (ইওসি) কার্যক্রমের আওতাভুক্ত হলেও এখন নেই। ফলে ঝুঁকি নিয়ে ৪৮ কিলোমিটার দূরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হয়। দীর্ঘ যাত্রায় জটিলতায় পড়তে হয় তাদের।

চিকিৎসকের ৩৭টি পদের বিপরীতে এখন কর্মরত আছেন সাতজন। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ জুনিয়র কনসালট্যান্ট, গাইনি, অ্যানেস্থেশিয়া, অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ আছেন। তবে আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (সার্জারি), শিশু, ফিজিক্যাল মেডিসিন, কার্ডিওলজি, চক্ষু, ইএনটি, চর্ম ও যৌন বিশেষজ্ঞ নেই। জ্বালানি সংকটে অ্যাম্বুলেন্স সেবাও ঠিকমতো পাওয়া যায় না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পীরগঞ্জসহ সাদুল্লাপুর, পলাশবাড়ী, বিরামপুর ও ঘোড়াঘাটের রোগীও এখানে আসেন। ফলে সাতজন চিকিৎসক রোগীর সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৬টি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন করে মেডিকেল অফিসার থাকার কথা থাকলেও শুধু জাফরপাড়ায় আছে। গত ২ সেপ্টেম্বর মাদারগঞ্জ ও খালাশপীরে ১০ শয্যাবিশিস্ট মা ও শিশু হাসপাতাল উদ্বোধন করা হয়েছে। সেখানেও চিকিৎসক নেই। ফলে বিপুল অর্থ ব্যয়ে করা হাসপাতাল দুটি কাজে আসছে না।

দায়িত্বরত আরএমও ছাড়া সবাই জেলা সদর থেকে যাতায়াত করেন। পদ শূন্য থাকায় ইউনিয়ন সেবাকেন্দ্রগুলোয় চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ। ৫৫টি কমিউনিটি ক্লিনিকে ৫৪ জন সিএইচসিপি থাকলেও কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। রয়েছে কর্মচারী সংকটও। তিনটি ওয়ার্ড বয়ের পদ থাকলেও আছেন দু’জন। পাঁচজন এমএলএসএসের স্থলে কর্মরত আছেন তিনজন।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মীর হোসেন বলেন, চিকিৎসক সংকটে রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্য সহকারী ৫৫ পদের ৩৩টি শূন্য থাকায় রুটিন ইপিআই কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট মেডিকেল অফিসার ১০টি, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দুটি, ফার্মাসিস্ট দুটি, সহ-স্বাস্থ্য পরিদর্শক সাতটি, স্বাস্থ্য পরিদর্শক তিনটি, অফিস সহায়ক আটটি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী তিনটি, নিরাপত্তা প্রহরী দুটি, বাবুর্চি দুটি, আয়া একটি ও জুনিয়ার মেকানিকসহ ১০৯ জনের পদ শূন্য রয়েছে।

গাইনি চিকিৎসক থাকলেও সার্জারি বিশেষজ্ঞ না থাকায় সিজার করা যাচ্ছে না বলে জানান মীর হোসেন। তবে চিকিৎসকদের কর্মস্থলে না থাকার বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি জানান, আগে হার্নিয়া, হাইড্রোসিল, এপেন্ডিসাইটিসের অস্ত্রোপচার হলেও এখন বন্ধ। টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে জটিল রোগীদের প্রজেক্টরে দেখিয়ে ঢাকার বিশেজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হয়। ১৫টি ইউনিয়নের ৫৫টি কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রশিক্ষিত কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রভাইডাররা অনিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা শামসুল আলম ও খুদু সরকার জানান, রোগীর উপচে পড়া ভিড় থাকলেও যে সংখ্যক চিকিৎসক প্রয়োজন, তা নেই। চিকিৎসককে দেখাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। প্রশাসনিকভাবে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ১০০ শয্যায় উন্নীত করার আহ্বান জানান পীরগঞ্জ নাগরিক কমিটি ও উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সেক্রেটারি এবং ব্যবসায়ী ফোরামের সভাপতি এনামুল হক। তিনি বলেন, দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করে সেবার মান বাড়াতে হবে।

জাসদের সভাপতি মীর মোহাম্মদ আলী মানিক বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৫০ শয্যার হলেও অধিকাংশ সময় ৭০ জনের বেশি রোগী ভর্তি থাকে। পাশের উপজেলার বাসিন্দারা চিকিৎসা নিতে আসায় ওষুধ, স্যালাইনসহ নানা সামগ্রীর সংকট থাকে। চিকিৎসক সংকট ও বেশি রোগী থাকায় সেবা ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চান উপজেলার চার লক্ষাধিক মানুষ।

এ বিষয়ে রংপুরের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন রুহুল আমিন বলেন, চিকিৎসকসহ জনবল সংকটের বিষয়টি বিভাগীয় পরিচালকসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জানানো হয়েছে। তবে পীরগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে কিংবা কাঙ্ক্ষিত সেবা না মেলার অভিযোগ আসেনি বলে দাবি করেন ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন। ‌

আরও পড়ুন