ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩

চোরাচালান ছেড়ে কৃষিতে মন

চোরাচালান ছেড়ে কৃষিতে মন

শ্রীবরদীর মেঘাদল বাজারে সবজি প্যাকেটজাত করছেন কয়েকজন শ্রমিক।ছবি: সমকাল

দেবাশীষ ভট্টাচার্য, শেরপুর

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

২০০৯-১০ সালের দিকের কথা। শেরপুরের গারো পাহাড়ের হারিয়াকোনা ও বাবেলাকোনাসহ ছয়-সাতটি গ্রামের বাসিন্দারা পাথর তুলে, গাছ কেটে ও চোরাচালানি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সীমান্ত পার হয়ে ভারতীয় নানা পণ্য, গরু ও মাদক এনে বিক্রি করতেন। পেটের তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে অনেকে বিএসএফের হাতে ধরা পড়েছেন। প্রাণহানিও ঘটেছে। বছরের পর বছর কেটেছে ভারতের জেলে। অনেকে নিরুদ্দেশও হয়েছেন। তখন কৃষিকাজে ১০-১৫ শতাংশ মানুষ যুক্ত ছিল বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।

 তবে সেদিন আর নেই। চোরাচালান ও অবৈধ ব্যবসা ছেড়ে কৃষিতে মনোযোগী হয়েছেন গারো পাহাড়ের মানুষ। বরবটি, চিচিঙ্গা, করলা, লাউ, আদা, হলুদসহ সবজি ও মসলার আবাদ করছেন। সীমান্তে স্বনির্ভর মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। গৃহপালিত পশু-পাখি লালনপালন করছেন।

হারিয়াকোনা গ্রামের প্রাঞ্জল এম সাংমার ভাষ্য, এক সময় অন্তত ৯০ শতাংশ মানুষ চোরাচালানে জড়িত ছিল। তবে গত ১৫ বছরে অন্তত ৭০ ভাগ মানুষ কৃষিতে মনোযোগী হয়েছেন। সবাই তিনবেলা খেতে পারলেই খুশি। ৫০-৬০ হাজার টাকা খরচে আবাদ করলে লাখ টাকায় বিক্রি হয়। এ জন্য তারা ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যেতে চান না।

স্থানীয়রা বলছেন, তারা স্বচ্ছল জীবনযাপন করছেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছেন। তাদের সহযোগিতা করছে কৃষি ও বন বিভাগ। কৃষি বিভাগ প্রশিক্ষণ ও বীজসহ উপকরণ দিচ্ছে। বন বিভাগ অলিখিতভাবে পতিত জমিতে চাষাবাদের সুযোগ দিয়েছে। আর্থিক সহায়তাও করছে।

সরেজমিন শ্রীবরদীর সীমান্তবর্তী বাবেলাকোনা, হারিয়াকোনা, কুমারগাতি বান্দাজোরা, তড়ইতলা, ধলবাড়ি ও চান্দাপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, বিস্তীর্ণ এলাকায় চলছে আবাদ। এখন বরবটি, চিচিঙ্গা ও লাউ উঠছে। পরিচর্যা চলছে আদা ও হলুদের। কেউ কেউ প্রস্তুতি নিচ্ছেন শীতকালীন সবজি চাষের। সবজি মেঘাদল শয়তান বাজারে বিক্রি করা হয়। পাইকাররা নিয়ে যান ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে। হারিয়াকোনা গ্রামে কৃষক সলোমন সাংমা, অটোল মারাক ও মিঠুন সাংমা বলছিলেন, সীমান্তে বিএসএফের নজরদারি ও হাতির চলাফেরার জায়গায় গেলে নিশ্চিত মৃত্যু। ফলে কেউ যেতে চান না। মিঠুনের ভাষ্য, পাহাড়ি জমিতে কৃষিকাজে অনেক লাভ। করলা বিক্রি করে লাখ টাকা এসেছে তাঁর। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভালো আছেন।

মেঘাদল বাজারে সবজি পিকআপে তোলায় জড়িত অন্তত ২০ জন শ্রমিক। এর মধ্যে রুবেল মিয়া ও আলমগীর হোসেন জানান, প্রত্যেকে ৫০০ টাকা করে পান। পাহাড়ি এলাকায় এমন আয়ে তারা খুশি। কথা হয় ব্যবসায়ী বেলাল হোসেন ও জহুরুল ইসলামের সঙ্গে। তাদের ভাষ্য, প্রতিদিন ৮-১০টি পিকআপে সবজি ঢাকায় যায়। তারা ১ হাজার ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা মণ বরবটি কিনছেন। ভালো মানেরগুলো ২ হাজার ৩০০ টাকা। তা লাভে বিক্রি করেন। পাহাড়ি সবজি স্বাদে-গন্ধে ভালো।

শ্রীবরদীতে ১১৫ হেক্টর জমিতে বরবটি আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ৮৫ হেক্টর ছয়-সাতটি পাহাড়ি গ্রামে বলে জানান কৃষি কর্মকর্তা সাবরিনা আফরিন। তিনি বলেন, হেক্টরপ্রতি বরবটি আবাদে খরচ ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। বিক্রি হয় সাড়ে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। ৭৫ হেক্টরে চিচিংগা হয়েছে। করলা ও আদাও লাভজনক। আদায় হেক্টরপ্রতি ২ থেকে আড়াই লাখ খরচে বিক্রি ৬-৭ লাখ টাকা। তিনটি সীমান্তে বন এলাকায় প্রায় দু’হাজার মানুষকে ৪২ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে বলে জানান শেরপুরের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. আবু ইউসুফ। সুবিধাভোগীরা এ টাকায় হাঁস-মুরগি ও গরু লালনপালন এবং সবজি চাষ করছেন। কেউ যাতে বিপথগামী না হয়, সেজন্য কাজ চলছে বলে জানান শ্রীবরদীর ইউএনও ইফতেখার ইউনুস। তাঁর ভাষ্য, বিভিন্ন দপ্তর সীমান্তে আয়বর্ধক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তার সুফল মিলছে। আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্যরা বলছেন, চোরাচালান কমেছে। শেরপুরের পুলিশ সুপার মোনালিসা বেগম বলেন, আগে সীমান্ত দুর্গম থাকায় অপরাধীদের আনাগোনা ছিল। চোরাচালান, মানবপাচার এবং অন্যান্য অপরাধ গত দশকের তুলনায় কমেছে।

আরও পড়ুন