নারী মৃত্যু
ডেঙ্গুও বুঝে গেছে নারীরাই সহজ টার্গেট

উম্মে রায়হানা
প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৩ | ১৪:১৩
এই মুহূর্তে সামাজিক মাধ্যম হোক বা মূলধারার গণমাধ্যম; চোখ খুললেই যা দেখা যায়, তাতে মনে হতে পারে বাংলাদেশের মূল সমস্যা সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল অর্থাৎ টাইগারদের দ্বৈরথ এবং আসন্ন ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ক্রিকেটারদের ইগো সমস্যা, মান-অভিমান ভাঙাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও প্রয়োজন পড়ছে বারবার। এদিকে নাটক-সিনেমার তারকারা বিশ্বকাপ ক্রিকেট সামনে রেখে সেলিব্রিটি ক্রিকেট লিগ খেলতে গিয়ে মারামারি করে জন্ম দিয়েছেন ন্যক্কারজনক সংবাদের।
এদিকে খবরে প্রকাশ, ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। মৃত্যু হচ্ছে দিনে ১৫ জনের। একই সঙ্গে রয়েছে একটি সুখবর। দেশে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু রোগের টিকার সফল পরীক্ষা হয়েছে। আইসিডিডিআর,বি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের গবেষকরা এই টিকার সফল পরীক্ষা করেছেন। টিকার নাম দেওয়া হয়েছে টিভি-০০৫। গত বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক সাময়িকী ল্যানসেট এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
ভালো কথা! ডেঙ্গু নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, টিকা আবিষ্কার হচ্ছে। কিন্তু আমরা এক আপ্তবাক্য শুনে বড় হয়েছি– প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। টিকা আবিষ্কারের পরের ধাপ হতে পারে টিকার বিক্রয় ও বিপণন। টিকার বিষয়ে ইমান-আমল আমাদের মধ্যে কী রকম, সে সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই; পরিসংখ্যানও ঘেঁটে দেখিনি। ব্যক্তিগতভাবে আমার মধ্যে টিকার ওপর ইমান আসেনি। টিকা-সংক্রান্ত কার্যক্রমকে ব্যবসা বলেই জ্ঞান করি। কিন্তু যেহেতু অফিস-কাচারিতে কাজকর্ম করতে হয়, রেস্তোরাঁয় খেতে হয়, পাসপোর্ট রিনিউ করাতে হয়; কাজেই কভিড টিকা তৃতীয় ডোজ পর্যন্ত নেওয়া শেষ করেছি; তারপর আর ধৈর্য হয়নি। শোনা যাচ্ছে, ডেঙ্গুর টিকা এক ডোজেই কাজ করবে! তাহলে তো অতি উত্তম!
টিকা মাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে; প্রয়োগ করতে আরও অনেক সময় লাগা স্বাভাবিক। টিকা নিয়ে আলাপের আগে দেখা দরকার দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আসলে কেমন! আইসিডিডিআর,বির জুলাই মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, গত ২২ বছরে ডেঙ্গু পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি দেখা গেছে প্রথমে ২০০০ সালে; তারপর ২০২২ সালে। গত সপ্তাহেই রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসায় ৪০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে সভায় জানানো হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের হর্তাকর্তারা উপস্থিত থাকলেও, নিমন্ত্রণ করা সত্ত্বেও স্থানীয় সরকারের কোনো প্রতিনিধি ওই সভায় উপস্থিত হননি।
ডেঙ্গুর জন্য বছরের কোন মাসটা সবচেয়ে ভয়াবহ? এ বিষয়ে রয়েছে মতান্তর। কোনো প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, মে থেকে সেপ্টেম্বর; কেউ জানাচ্ছেন আগস্ট থেকে অক্টোবর। সাধারণ জ্ঞান বলে, বৃষ্টি থেকে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা ডেঙ্গু রোগ ছড়ানোর উর্বর ক্ষেত্র। যে দেশের রাজধানীতে মাত্র কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে পানি জমে বন্যা হয়ে যায়; বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে নিহত হয় শিশুসহ একাধিক মানুষ, সেখানে জলাবদ্ধতা নিরসনে কেমন কাজ করা হচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়।
এ বিষয়ে উন্নয়নবাদীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী জনগণই। যত্রতত্র পলিথিন আর চিপসের প্যাকেট ফেলতে ফেলতেই নাকি শহরে জমে যাচ্ছে পানি! এই বয়ানের ফাঁকিবাজির অংশটুকু বাদ দিয়েই প্রশ্ন রাখা যায়, আমরা রোজ সকালে অফিসে যাওয়ার পথে এবং রাত করে বাড়ি ফেরার পথে যে সবুজ অ্যাপ্রন পরা পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের দেখি, তারা কি কাজ না করেই বেতন নেয়? নিশ্চয়ই নয়। নগরের রাস্তাঘাট যদি একদিন ঝাড়ু দেওয়া না হয়; আমি নিশ্চিত– পরদিন আমরা কেউ রাস্তা ধরে কাজে যেতে পারব না। সে যা-ই হোক, জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা যে ব্যর্থ হয়েছে– এ কথা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়। ডেঙ্গু রোগ মহামারি আকার ধারণ করেছে! কর্তৃপক্ষ স্বীকার করুক আর না-ই করুক; সংবাদমাধ্যম এ কথা বলেও যাচ্ছে।
এর আগে কভিড-১৯ মহামারি এবং মহামারি-পরবর্তী পরিবর্তনে দেখা গেছে জেন্ডার ডাইমেনশন। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখিয়েছে, মহামারি ও তার পরবর্তী সময় নারীর জন্য নিয়ে এসেছে দ্বিগুণ বিভীষিকা। লকডাউনে বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা। চাকরি হারানোর লাইনেও নারীর সংখ্যা ছিল বেশি, বিশেষত গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করা নারী, যাদের আমরা ‘ঠিকা বুয়া’ বলি, তারা অনেকেই বেকারত্ব বরণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে এখনও এ ধরনের গবেষণা শুরু হয়নি। কিন্তু মাস দুয়েক আগেই একটি খবর চোখে পড়ে। এক রিপোর্ট বলছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে পুরুষেরা বেশি, কিন্তু মারা যাচ্ছে বেশি সংখ্যক নারী। এর পেছনে চিকিৎসাবিদ্যার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকলেও থাকতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ খবর পাঠ করেছি সমাজতাত্ত্বিক সংকট হিসেবেই। এর আগে ডেঙ্গু নিয়ে একটি সচেতনমূলক প্রচারও চোখে পড়েছিল। কয়েক বছর আগে এক সরকারি প্রচারণায় দেখানো হয়েছিল, একটি পরিবারের কর্তা বা পুরুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে, পরিবারের নারী বা স্ত্রী বা মা স্বগতোক্তির মতো করে বলেন, সংসার চলবে কেমন করে!
পরিবারের প্রধান বা একমাত্র রোজগেরে মানুষ হিসেবে পুরুষকে দেখানোর এই প্রবণতা অত্যন্ত আপত্তিকর। এ ছাড়া পরিবারের কোনো সদস্যের জীবনের মূল্য তার আয় করা অর্থের ভিত্তিতে নির্ধারিত হতে পারে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ দেশের মানুষ এমন করেই ভাবে। যে কারণে এমন ক্যাম্পেইন তৈরি হয়, পাস হয়; প্রচার করা হয় গণমাধ্যমে। ফলে ধরে নেওয়া যায়, আক্রান্ত পুরুষের সেবা করতে গিয়েই আক্রান্ত হন পরিবারের নারী সদস্যরা। নারী বলে, আয় কম বা নেই বলে তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসাসেবা নেওয়া হয় কম। কোনো ক্ষেত্রে হয়তো নেওয়াই হয় না। আমাদের দেশের অধিকাংশ পরিবারের যে আর্থিক অবস্থা এবং মানসিকতা, সেখানে পুরুষের তুলনায় নারীর অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা হয় কম। ফলে তারা মারা পড়েন বেঘোরে। বিষয়টি নিয়ে লিখতে গিয়ে দাবির সপক্ষে পরিসংখ্যান খুঁজতে গিয়ে কিছুই পেলাম না। তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি, কভিড মহামারির মতোই ডেঙ্গু মহামারির লৈঙ্গিক দিক নিয়ে আলোচনা শুরু করাও প্রয়োজন।
উম্মে রায়হানা: কবি ও সাংবাদিক
- বিষয় :
- ডেঙ্গু
- উম্মে রায়হানা
- নারী মৃত্যু
- গণমাধ্যম