তিন বছরে বন্ধ ৫ হাজার তাঁত

জালাল উদ্দিন, সাঁথিয়া (পাবনা)
প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৩ | ০৬:১২ | আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৩ | ০৬:১২
আগে ২২টি তাঁত ছিল সাঁথিয়ার পিপুলিয়া গ্রামের ফুল মিয়ার। তবে লোকসানের কারণে তিনটি রেখে সব বিক্রি করে দিয়েছেন। একই এলাকার জাহিদ ফকিরের তিনটি তাঁতের সবগুই বন্ধ করেছেন। বাবু মোল্লার আটটি তাঁতের মধ্যে তিনটি আছে। ঋণ শোধের জন্য এ তিনটিও বিক্রি করবেন। এভাবে ৩ বছরে এলাকার সাড়ে ৫ হাজার তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ এক সময় তাঁতের মাকুর খটখট শব্দে মানুষের ঘুম ভাঙত। এখন সুনসান নীরবতা।
স্থানীয় সূত্র বলছে, তাঁতপণ্য উৎপাদনের উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অনেক তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। লোকসান সামলাতে ভিটেমাটি ও সহায়-সম্বল বিক্রি করেছেন। বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অনেকে বিভিন্ন পেশায় গেছেন। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পরিবারসহ গ্রাম ছাড়ার নজিরও আছে।
তাঁতিরা জানান, আগে তিন ধরনের তাঁতু খটখটি, পিটলুম ও চিত্তরঞ্জনের প্রচলন ছিল। এগুলো তৈরিতে খরচ হতো ৬ হাজার টাকা। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকায়। আর অটো পাওয়ারলুম তৈরিতে খরচ হয় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। বাংলা পাওয়ারলুমের খরচ ৪৫ হাজার টাকা। এগুলো অনেকে ভাঙাড়ির দোকানে ১০-১২ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। প্রবীণ তাঁতি আলতাফ হোসেন জানান, তাঁত বন্ধ থাকায় পাটের নেট বানিয়ে সংসার চালানোর চেষ্টা করছেন। তবে অভ্যস্ত না হওয়ায় দিনে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা আয় হয়।
সাঁথিয়া তাঁত বোর্ড বেসিক সেন্টার থেকে জানা গেছে, ২০২০ ও ২০২১ সালের সর্বশেষ জরিপে সেন্টারের অধীন তিন উপজেলায় তাঁত ছিল ১১ হাজার ২৯৩টি। তবে ৫ হাজার ৬৪৬টি কমে বর্তমানে ৫ হাজার ৬৪৭টিতে দাঁড়িয়েছে। আগে ৪ হাজার ৩৪৫ মালিকের অধীনে ৪ হাজার মানুষ কাজ করতেন। ২ হাজার ১৯৫ মালিক ও ২ হাজার শ্রমিক কমে এখন ২ হাজার ১৫০ জনের অধীনে ২ হাজার জন কাজ করেন।
তাঁতিদের বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে, দু-একটি তাঁত চালু থাকলেও অধিকাংশই বন্ধ। জমেছে ধুলার আস্তর। শ্রমিকরা আগে দুই শিফটে কাজ করলেও এখন নিয়মিত কাজ থাকে না।
কারিগরপাড়া, পিপুলিয়া, শশদিয়া, নওয়ানী, পিয়াদহসহ কয়েকটি গ্রামের তাঁত মালিক ও শ্রমিকরা জানান, সুতা, রং ও রাসায়নিক দ্রব্যের দাম বেড়েছে তিন গুণ পর্যন্ত। বছরখানেক আগে এক তোলা রং ৮ টাকায় কিনলেও এখন ৭৫ টাকা। চল্লিশ কাউন্টের এক ডোপ (সাড়ে আট বান্ডিল) রনক সুতা ছিল ১১ হাজার টাকা, এখন বেড়ে হয়েছে ২০ হাজার টাকা।
ডেলটা দোয়েল ডোপের দাম ছিল ১৩ হাজার, এখন ২৩ হাজার টাকা। ৬২ কাউন্টের সুতার দাম ১৫ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে ২৭ হাজার টাকা। ৮২ কাউন্টের সুতা ১৮ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৮ হাজার টাকা। এক বস্তা কস্টিক সোডা ১ হাজার ২৫০ থেকে বেড়ে ৫ হাজার, এক ড্রাম হাইড্রোস ২ হাজার ২০০ থেকে বেড়ে ৮ হাজার টাকা হয়েছে। এতে লুঙ্গি ও শাড়ির উৎপাদন খরচও বেড়েছে। তবে সে অনুপাতে কাপড়ের দাম বাড়েনি। আগে প্রতি থান (চারটি) লুঙ্গি ৭০০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ৭৩০ টাকা। বাউশগাড়ী গ্রামের এরশাদ আলী ও পিপুলিয়ার ফজলুল হক জানান, প্রতিটি লুঙ্গির মজুরি ৭০ টাকা পান। দিনে তিনটি বুনতে পারেন। এতে সংসার চলে না। পেশা বদলের কথা ভাবছেন।
তাঁত মালিক নওয়ানী গ্রামের সেলিম ও আলীম লোকসান ও ঋণের কারণে পেশা বদলে এলাকা ছেড়েছেন। তারা পোশাক কারখানায় কাজ করছেন। মহাজনদের দৌরাত্ম্যেও অনেকে পেশা ছাড়ছেন। অনেকে ঋণের জালে পেশা বদলে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়েছেন।
পৌর সদরের তাঁত মালিক হাফিজুর রহমান লাল বলেন, উপকরণের দাম বাড়লেও লুঙ্গি, গামছা ও শাড়ির দাম কম। লোকসান করে টিকে থাকা সম্ভব নয়। সাঁথিয়া পৌরসভার ৭, ৮, ৯ নম্বর ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতির সভাপতি রহম আলী বলেন, তাদের সমিতির ৩১০ জন সদস্যের ৮০০ তাঁত ছিল। তবে ৪০০টি বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁতিদের পেশা টিকিয়ে রাখতে সুতার দাম কমাতে হবে। তাঁতিদের কার্ড, ভর্তুকি, স্বল্পসুদে ঋণের দাবি জানান তিনি।
সাঁথিয়া তাঁত বোর্ড বেসিক সেন্টারের সমন্বয়কারী কর্মকর্তা বসুদেব চন্দ্র দাস বলেন, অনেকে তাঁত বোর্ড থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করে চলে গেছেন। একজন অন্য কাজে দিনে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা আয় করলেও তাঁতে আয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। মহাজনদের কাছ থেকে উপকরণ বেশি দামে কিনে পণ্য তাদের দেন কম দামে। মহাজনদের দৌরাত্ম্যেও তাঁতিরা পেশা ছাড়ছেন।