অন্যায়ে অন্যায়ে পর্যুদস্ত মানুষ

বৃষ্টি ও নদীর পানি সংরক্ষণ করে কৃষকের কাছে পৌঁছাতে চারঘাটের ইউসুফপুর-পুঠিয়ার ভালুকগাছি পর্যন্ত খাল খনন করলেও উৎসমুখেই পানি নেই সমকাল
সনি আজাদ, চারঘাট (রাজশাহী)
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৪ | ২৩:২৬ | আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১১:১৭
গত বছরের ২১ মার্চ সেচের পানি না পেয়ে জমিতে দাঁড়িয়ে কীটনাশক পান করেন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নিমঘুটু গ্রামের কৃষক অভিনাথ মার্ডি ও তাঁর কাকাতো ভাই রবি মার্ডি। পরে দু’জনই মারা যান। ৯ এপ্রিল একই কারণে গভীর নলকূপের সামনে মুকুল সরেন কীটনাশক পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পানির জন্য অভিনাথ মার্ডি ও রবি মার্ডি জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন– বরেন্দ্র সেই ভূমি, যেখানে পানিই জীবন।
বরেন্দ্র অঞ্চলে খাবার ও সেচের পানির ভয়াবহ সংকট। এ অঞ্চলের ৪০ শতাংশেরও বেশি ইউনিয়নে পানিশূন্যতা দেখা দিয়েছে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায় চালানো পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। এ অঞ্চলের ২১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮৭টিকে অতি উচ্চ ও উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
২০২৩ সালের আগস্টে প্রকাশিত ওয়ারপোর গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৯০ সালে এ অঞ্চলে গড় ভূগর্ভের পানির স্তর ছিল ৮ মিটার। ২০১০ সালে গড় স্তর ১৫ মিটার এবং ২০২১ সালে ১৮ মিটার ছাড়িয়ে যায়। রাজশাহীর তানোরের বাধাইড় এলাকায় ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে সর্বোচ্চ ৪৬ মিটার পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়। কয়েক দশক ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূগর্ভের পানি উত্তোলনের ফলেই এ পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির সমবণ্টনের কথা বলছেন। তাঁরা ভূপৃষ্ঠের পানির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। পাশাপাশি পানিসাশ্রয়ী ফসলের চাষাবাদ বাড়ানোর পরামর্শ তাদের।
বন্ধ হয়নি গভীর নলকূপ স্থাপন
এ অঞ্চলের পানি সংকট নিরসনে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানোর সুপারিশ করেছে ওয়ারপো। এর আগে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (বিএমডিএ) একই সুপারিশ করে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দেয়। ভূগর্ভের পানির স্তর নামা শুরু করলে ২০১২ সালে গভীর নলকূপ স্থাপন বন্ধ করে দেয় বিএমডিএ। ব্যক্তি পর্যায়েও নলকূপ স্থাপনে অনুমোদন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরপরও পানি সংকটে রেড জোন তানোর উপজেলায় ৩০টি, চারঘাটে ৬টি, পুঠিয়ায় ৯টি ও মোহনপুরে ১টি গভীর নলকূপ স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
বিএমডিএর তথ্যমতে, সেচকাজে ব্যবহৃত পানির ৫২ শতাংশ বিএমডিএ ও ৪৮ শতাংশ বেসরকারি পর্যায়ের নলকূপ থেকে সরবরাহ করা হয়। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬টি জেলায় বরেন্দ্র অঞ্চলে ১৫ হাজার ৮২৩টি সরকারি এবং প্রায় ৫৬ হাজার ব্যক্তিচালিত গভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীতে ২ হাজার ৮৭০টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১ হাজার ৬১৫টি ও নওগাঁয় ৪ হাজার ১০২টি। ভূগর্ভের পানি কমে যাওয়া এ তিন জেলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
পানি সংকটের কারণে ফসল আবাদ ব্যাহত হচ্ছে। গোদাগাড়ীর নিমঘুটু গ্রামের কৃষক দুর্জয় ওরাওঁ ৬ বিঘা জমিতে আবাদ করেছেন। তিনি বলেন, আগে গভীর নলকূপ থেকে এক ঘণ্টায় যে পরিমাণ পানি উঠত; স্তর নেমে যাওয়ায় ২ ঘণ্টাতেও সে পরিমাণ মিলছে না। এ অবস্থায় ফলন আশানুরূপ হবে কিনা, তা নিয়ে তিনি সন্দিহান।
বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশীদ বলেন, গভীর নলকূপ স্থাপন বন্ধ আছে। আগে শতভাগ ভূগর্ভ থেকে পানি তুললেও এখন ১৪ ভাগ নদী, খাল ও পুকুর-সংশ্লিষ্ট প্রকল্প থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেচ কমিটি কেন গভীর নলকূপ স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।
জনস্বাস্থ্যের প্রকল্পে অনিয়ম
ওয়ারপো ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দিলেও রাজশাহী জেলার ৭২টি ইউনিয়নে বছরে ২৬টি; প্রায় ৬ হাজার সাবমার্সিবল স্থাপন করেছে জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর। সেগুলো সরবরাহেও অনিয়ম হয়েছে। এতে সংকট আরও প্রকট হয়েছে।
জনস্বাস্থ্যের নলকূপগুলো রাজনৈতিক নেতারা স্বজনের বাড়িতে বসিয়েছেন অভিযোগ করে চারঘাটের অনুপামপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেন বলেন, তা ছাড়া যেখানে ভূগর্ভের পানি কম ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা, সেখানে সাবমার্সিবল স্থাপন অদূরদর্শিতার পরিচায়ক।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের রাজশাহী সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বাদশাহ মিয়া বলেন, ‘আমরা মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করি। প্রকল্প গ্রহণের এখতিয়ার মন্ত্রণালয়ের। আর জনপ্রতিনিধিদের অনুরোধে দু-একটি পাম্প স্থাপনে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটতে পারে।’
খাল খনন প্রকল্পে দায়সারা কাজ
ভূগর্ভের পানির ব্যবহার কমিয়ে উপরিভাগের পানি দিয়ে চাষাবাদের জন্য নদী ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহীর চার উপজেলায় খাল খনন করেছে বিএমডিএ।
দরপত্রে শাহাপুর-কাটাখালী-হরিয়ান বিলে ৩ থেকে ৯ ফুট গভীর করে খননের কথা বলা হলেও কোথাও দুই ফুট, আবার কোথাও কোনো খননই করা হয়নি। উল্টো ময়লা-আবর্জনায় খাল ভরাট হয়ে গেছে। খালপাড়ের মোল্লাপাড়া এলাকার ইমদাদুল ইসলাম বলেন, পানিপ্রবাহ সচল রাখতে খালটি খনন করা হয়েছিল। কিন্তু পানি নামেও না কিংবা পদ্মা থেকে খালে আসেও না।
চারঘাটের মেরামাতপুর-পিরোজপুর খালটি ২০ ফুট চওড়া করার কথা। কিছু জায়গায় ৩ থেকে ৬ ফুট চওড়া করা হয়েছে। স্থানীয় কৃষক জিয়াউর রহমান বলেন, খাল খননের পর মাটি ফেলা হয়েছে পাড়েই। আবার যে পরিমাণ গভীর করার কথা ছিল, সেটা হয়নি। বছর না যেতেই খাল ভরাট হয়ে গেছে।
ইউসুফপুর-পুঠিয়ার ভালুকগাছী খালে পদ্মা থেকে পানি সরবরাহের জন্য ১৩টি পাম্প স্থাপনের কথা। সেখানে ৭টি পাম্প পাওয়া গেছে। সচল আছে ৪টি। এ খালেও পানি নেই। এত অব্যবস্থাপনার পরও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ভূপৃষ্ঠের পানির সুষম ব্যবহার নিশ্চিতের নামে বিএমডিএ তিনটি গুচ্ছে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে আরও ৬৭৭ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে। এর বাস্তবায়ন নিয়েও সন্দিহান কৃষকরা।
তবে খাল খননে অনিয়ম হয়নি দাবি করে বিএমডিএর রাজশাহী রিজিয়নের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কৃষকদের পানির চাহিদা সারাবছর থাকে না। এ জন্য সব সময় তা নজরে আসে না। কৃষকরা চাইলে খালগুলো পরিষ্কার করে সেচের ব্যবস্থা করা হবে।
ফসল আবাদে আগ্রহ হারাচ্ছে কৃষক
বিএমডিএর আওতায় রাজশাহী জেলায় ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৭৯ হেক্টর জমি রয়েছে। এর মধ্যে গত বছর ৪৮ হাজার হেক্টরে এবং চলতি বছর ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। পানি সংকটের কারণে ফসল আবাদে আগ্রহ হারাচ্ছে কৃষক।
তানোরের মোহাম্মদপুর গ্রামের আব্দুস সালাম ২০ বিঘা জমিতে ধান আবাদ করতেন। গত বছর ১২ বিঘা এবং এ বছর ৭ বিঘা জমিতে আবাদ করেছেন। প্রতিবছরই আবাদের পরিমাণ কমছে। আব্দুস সালাম বলেন, ‘হাতের নাগালে সার, বীজসহ সব আছে; শুধু পানি নেই। গত বছর ঘণ্টায় ১২৫ টাকা দরে পানি কিনেছি। এ বছর দাম বেড়ে হয়েছে ১৪৫ টাকা। বেশি টাকা দিয়েও পানি পাব, সে ভরসা নেই।’
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের পানির সমবণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। ভূপষ্ঠের পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে পানিসাশ্রয়ী ফসল যেমন আলু, ভুট্টা ও তুলার চাষ বাড়াতে হবে বলে মন্তব্য তাঁর।
- বিষয় :
- পানি
- সেচপাম্প
- কৃষি
- বরেন্দ্র অঞ্চল