চার বছর ফাও খাচ্ছেন তারা

.
তৌফিকুল ইসলাম বাবর, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৪ | ০১:১৪
সরকারি বা বেসরকারি অফিসে কোনো বিষয় প্রতিপালনে সাধারণত অফিস আদেশ দেওয়া হয়। সেটি মেনে চলে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড। তবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) ঢাকা রেস্টহাউসের অস্থায়ী কর্মচারীরা যে অভিনব জালিয়াতি করেছেন, তাতে যে কারও চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। দুপুরে ফাও খাবার খেতে তারা ভুয়া স্মারক নম্বর ব্যবহার করে তৈরি করেছেন ভুয়া অফিস আদেশ। এভাবেই প্রায় চার বছর ধরে চলে এমন জালিয়াতি।
এতদিন ধরে ঘুণাক্ষরেও বিষয়টি কেউ আঁচ করতে পারেননি। তবে সম্প্রতি এটি কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। অত্যন্ত সুকৌশলে এবং কারসাজির মাধ্যমে এই খাবার খেয়ে আসছেন তারা। ইতোমধ্যে অবৈধভাবে অর্ধকোটি টাকারও বেশি খাবার খেয়েছেন অস্থায়ী কর্মচারীরা। রেস্টহাউসের নিরাপত্তাকর্মী ও বেয়ারা-বাবুর্চিদের এমন কারসাজিতে হতবাক সংস্থাটির কর্মকর্তারা। তাদের খাবারের এই বিল পরিশোধ করে আসছে বিপিসির আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড। বিষয়টি জানার পর বিস্মিত এই কোম্পানির কর্মকর্তারাও। অভিযোগ রয়েছে, রেস্টহাউসের কেয়ারটেকার ও পদ্মা অয়েলের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. মনিরুজ্জামান এই কারসাজির সঙ্গে জড়িত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানিয়েছেন, বিশেষ কিছু শর্ত সাপেক্ষে অস্থায়ী কর্মচারীরা চাকরি করে থাকেন। দুপুরের খাবারের বিষয়টি সেখানে নেই। তার পরও তারা আবেদন করলে হয়তো বিপিসি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করত। কিন্তু তারা সেটা না করে এক ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বছরের পর বছর দুপুরের খাবার খেয়ে আসছেন।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা অফিসেই দুপুরের খাবার খেয়ে থাকেন। তাদের পাশাপাশি কর্মচারীরাও এই সুবিধা ভোগ করেন। ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ সমন্বয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কর্মকর্তাদের মতো কর্মচারীরাও খাবার খেয়ে থাকেন। ঢাকার লিয়াজোঁ অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য ঢাকা রেস্টহাউস থেকে রান্না করে খাবার পাঠানো হয়। কিন্তু তাদের সঙ্গে এখানকার অস্থায়ী ১০ কর্মচারীর খাবার বিষয়ে সিদ্ধান্ত ছিল না। ফলে তাদের এই সুবিধা পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারা জালিয়াতির মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে খাবার খেয়ে আসছেন।
এ নিয়ে বিপিসির অভ্যন্তরীণ এক পর্যালোচনায় দেখা যায়, কর্মকর্তা-কর্মচারীর খাবারের বিল তাদের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের পক্ষ থেকে পরিশোধ করা হয়। বিপিসি কর্তৃপক্ষের নামে পদ্মা অয়েলে একটি চিঠি দেওয়া হয়। তাতে অস্থায়ী কর্মচারীদের খাবার বিলও পরিশোধের কথা বলা হয়। কিন্তু এই চিঠি বিপিসি কর্তৃপক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। এতে দাপ্তরিক যে স্মারক নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে, সেটিও ভুয়া। অর্থাৎ বিপিসির কোনো শাখা কিংবা বিভাগ থেকে এই ধরনের নম্বরের কোনো স্মারকে কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি। এই চিঠির অনুলিপি সংস্থার মহাব্যবস্থাপককে দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হলেও, প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের কোনো অনুলিপি মহাব্যবস্থাপককে দেওয়া হয়নি। তাছাড়া এ নিয়ে বিপিসির কোনো অফিস আদেশও নেই। কিন্তু বিষয়টি সংস্থার জন্য বিব্রতকর হওয়ায় এ নিয়ে মুখ খুলতে চান না সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা।
জানতে চাইলে বিপিসির সচিব মুহম্মদ আশরাফ হোসেন সমকালকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে অনুমোদন ছাড়া কেউ খাবার খেতে পারেন না। এ ব্যাপারে আমি খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।
বিপিসির ঢাকা রেস্টহাউসের দায়িত্বে থাকা পদ্মা অয়েলের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. মনিরুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে প্রথমে বিষয়টি অস্বীকার করেন। পরে তিনি বলেন, কোনো অস্থায়ী কর্মচারী অফিসে দুপুরের খাবার খান না। তাদের খাবার বিল কেন দেওয়া হয়– জানতে চাইলে বলেন, আগে তারা খাবার খেতেন। এখন খান না।
এদিকে, বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে গত ২৮ এপ্রিল বিপিসির ঢাকার রেস্টহাউসের অস্থায়ী কর্মচারীরা বিপিসির সচিবকে চিঠি দেন। তাতে তাদের দুপুরের খাবার নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরির বিষয়টি উল্লেখ করেন। এতে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। তারা চিঠিতে বিপিসির অফিস আদেশে অস্থায়ী কর্মচারীদের খাবার বিষয়টি উল্লেখ না থাকায় এ বিষয়ে নির্দেশনা চান।
জানা যায়, অফিস আদেশ অনুযায়ী ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর থেকে ঢাকার লিয়াজোঁ অফিসের স্থায়ী কর্মচারীরা খাবার খেয়ে আসছেন। তখন থেকে অস্থায়ী কর্মচারীরাও খাবার খাচ্ছেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীর খাবার বিল আগে ১৫০ টাকা করে নির্ধারণ থাকলেও গত ৭ মার্চ বিপিসির সচিব স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তা ৫০ টাকা বাড়িয়ে ২০০ টাকা করা হয়।
- বিষয় :
- বিপিসি