মাসে দু-একবার খোলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তালা

ফাইল ছবি
মুরাদ মৃধা, নাসিরনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৪ | ২৩:৩৬ | আপডেট: ১৫ জুন ২০২৪ | ০৮:০৩
নূরজাহান বেগম-নাজির মিয়া দম্পতির চার ছেলেমেয়ে। এ দম্পতির বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার হাওর অধ্যুষিত গোয়ালনগর ইউনিয়নের দক্ষিণদিয়া গ্রামে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে গর্ভধারণ করেন নূরজাহান। কয়েক মাস নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা নেন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে। এর পরপরই অজ্ঞাত কারণে বন্ধ হয়ে যায় সেটি। চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল প্রসব ব্যথা শুরু হলে স্থানীয় ধাত্রীর সহায়তায় সন্তান প্রসব করেন নূরজাহান। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও প্রসব-পরবর্তী জটিলতায় মারা যান তিনি। সেই সঙ্গে বিনা চিকিৎসায় প্রাণ যায় নবজাতকেরও।
ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার বেহাল এমন চিত্র উপজেলার সর্বত্র। নূরজাহানের দেবর মো. কামাল মিয়ার ভাষ্য, যদি গোয়ালনগর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটিতে চিকিৎসাসেবা চালু থাকত, তাহলে তাঁর ভাবিকে এভাবে জীবন দিতে হতো না। এমন কত নারী এভাবে প্রাণ দিলে অবস্থার উন্নতি হবে– প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি।
নৌকায় দীর্ঘ যাত্রার পর ৫ জুন সকাল ৯টার দিকে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে যান এই প্রতিবেদক। ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষার পরও কোনো কর্মকর্তার খোঁজ মেলেনি। স্থানীয়দের কথায় পাশের বাসা থেকে ডেকে আনা হয় আয়া পারুল বেগমকে। ঘড়ির কাঁটায় তখন ১০টা ৫ মিনিট। হাজিরা খাতার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, সেটি বাসায়।
একই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ২৫ এপ্রিল গিয়ে দেখা গিয়েছিল অনিয়মের চিত্র। হাজিরা খাতায় ফেব্রুয়ারি মাসে ২৩ দিন সই করেছিলেন কেন্দ্রটির পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক আলী আকবর। এলাকাবাসী জানায়, ওই মাসে তাঁকে একদিন আসতে দেখেছিলেন। এ ছাড়া মার্চ মাসে ৯ দিন সই করলেও একদিনও আসেননি। গোটা এপ্রিল মাসই অনুপস্থিত ছিলেন।
জানা যায়, এই কেন্দ্রটিতে থাকার কথা একজন উপসহকারী মেডিকেল অফিসার, একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক, একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা, একজন আয়া ও একজন নিরাপত্তা প্রহরী। অথচ পরিদর্শক হিসেবে আলী আকবর ও আয়া হিসেবে পারুল আক্তার ছাড়া কোনো পদায়ন নেই। বাসা লাগোয়া অফিস হলেও এপ্রিল মাসে হাজিরা খাতায় সই করেননি পারুল। এলাকাবাসী জানায়, তিনি অফিসও খোলেন না। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে পারুল বলেন, ‘অফিস খুইল্যা কিতা করুম। আমি অশিক্ষিত মানুষ। আমি কি কোনো রোগীরে ওষুদ দিতা পারুম? এইখানে হাসপাতালের কোনো লোক আসে না, তাই অফিসও খুলি না।’
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, মাসে দু-একবার অফিসের তালা খোলা হয়। তখনই হাজিরা খাতায় সই করে চলে যান পরিদর্শক আলী আকবর। এসব বিষয়ে মন্তব্য জানতে দফায় দফায় তাঁর মোবাইল ফোনে কল দিয়ে বন্ধ পাওয়া যায়।
সেদিন লোহজ উদ্দিন নামের এক বৃদ্ধ বলেন, ‘আমরা কামলা মানুষ, ক্ষেতে-খামারে কাম করি। শরীরে বিষ-বেদনা করে। এর লাইগ্যা আইছি কডা গোলি (ব্যথার ট্যাবলেট) নিতাম। কিন্তু আইলে কিতা অইব, হেরারে (কর্মী) পাই না।’
২৪ এপ্রিল চাপরতলা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি তালাবদ্ধ দেখা যায়। দীর্ঘ অপেক্ষা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়দের ভাষ্য, আগে কেন্দ্রটি মাসে দু-একবার খোলা হতো। বছরখানেক ধরে তালা খোলাই হয়নি। স্থানীয় মো. হাবিব মিয়ার ভাষ্য, দেড়-দুই বছর ধরে এই কেন্দ্রটি অচল। হাসপাতালের লোকও আসে না, সেবা নিতেও আসেন না কেউ। কেন্দ্রটির ওপর তলায় একজন নিরাপত্তা প্রহরী থাকেন। তিনি মাঝেমধ্যে তালা খোলেন।
একই দিন ধরমণ্ডল ইউনিয়নের স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির দরজা-জানালা বন্ধ দেখা যায়। পাশেই কয়েকজন নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা বলেন, কয়েক বছর ধরে এটি খোলা হয় না। সরকারি ওষুধ বিক্রি করে দেয় কর্মীরা।
ধরমণ্ডল ইউপি চেয়ারম্যান মো. শফিক মিয়া বলেন, ‘বছরেও একবার ইডা খোলা হয় কিনা আমার জানা নাই। গত বছর আমি নিজের টাকা দিয়া ওই কেন্দ্রের লাইগ্যা আইপিএস কিন্যা দিছি। কিন্তু তাইনেরা (স্বাস্থ্যকর্মী) দরজা-জানালাও খোলে না। মানুষ আমার কাছে বিচার দেয়। মাসিক মিটিংয়ে জানাইছি। কোনো লাভ অয় নাই।’
২৮ এপ্রিল কুণ্ডা ইউনিয়নের কেন্দ্রে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি। দেয়াল টপকে ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, কক্ষের ভেতরে লাইট-ফ্যান চলছে। এলাকাবাসী জানায়, বিদ্যুৎ থাকলে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি চলতে থাকে। বিদ্যুৎ চলে গেলে বন্ধ হয়ে যায়। চত্বরের দুটি গভীর নলকূপের ওপরের অংশ চুরি গেছে। জানালার বিভিন্ন অংশ ভেঙে মেঝেতে পড়ে আছে। জানা যায়, এখানে পরিদর্শিকার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন পাশের ভলাকোট ইউনিয়ন কেন্দ্রের পরিদর্শিকা ফাতেমা আক্তার। তবে তাঁকে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার বলে জানান স্থানীয়রা।
ওই এলাকার আঙ্গুরা বেগম বলেন, ‘ইডা সারাবছর বন্ধ থাহে। ইডার ভিতরে লাইট-ফ্যান নিজে নিজে চলে আবার বন্ধ হয়। কুছতা কইলে আমাদের পুলিশ দিয়া ধরাই দিব কইয়া হুমকি দেয়। আর ওষুদের (ওষুধ) কথা কিতা কইতাম! আইলেই কয় ওষুদ নাই। নাসিরনগর থিক্যা কিন্যা আনতাম। আমরা গরিব মানুষ। টেহা থাকলে কি আর সরকারি হাসপাতালে আই?’
সমুজ আলী বলেন, ‘মন চাইলে তাইন (স্বাস্থ্যকর্মী) হাসপাতালে আসে, না চাইলে হাসপাতালে আসে না। কিন্তু গরিব মানুষ সেবার জন্য প্রতিদিনই আসে। আমিও আইছি মেলা দিন। কিন্তু তাইনরে না পাইয়া নাসিরনগর থেইক্যা টেহা দিয়া দাওয়াই কিন্যা আনছি।’
হাওরবেষ্টিত উপজেলাটির গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে তিনটি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, আটটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ও ১০ শয্যাবিশিষ্ট একটি পল্লি স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব কেন্দ্রের সব ক’টি ধুঁকছে জনবল সংকটে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, তেরটি ইউনিয়নের প্রতিটি কেন্দ্রে ১৩টি মেডিকেল অফিসার (চিকিৎসক) পদের বিপরীতে একজনও নেই। একজন করে উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (সেকমো) থাকার কথা। কিন্তু একজনও নেই। পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা থাকার কথা ১৩ জন, আছেন পাঁচজন। পরিদর্শক ১৩ জনের জায়গায় আছেন ১২ জন। ১৩ জন ফার্মাসিস্ট থাকার কথা। আছেন একজন। আয়া থাকার কথা ১৩ জন, আছেন পাঁচজন। নৈশপ্রহরী থাকার কথা ১৩ জন, একজনও নেই। মোট ৯১টি পদের বিপরীতে পদায়ন আছে ২৩টিতে।
উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রায়হানুল ইসলাম এসব তথ্য স্বীকার করে বলেন, জনবল সংকটের কারণে কেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকে। ওষুধ বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে এটি তাঁর দায়িত্ব নয় বলে এড়িয়ে যান। তিনি পরামর্শ দেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে কথা বলতে। ডা. অভিজিৎ রায় দাবি করেন, ‘স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ওষুধ বিক্রির বিষয়টি প্রথম জানলাম।’
- বিষয় :
- স্বাস্থ্যসেবা
- ব্রাহ্মণবাড়িয়া