ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

নদীভাঙনের আতঙ্ক তিন গ্রামে

নদীভাঙনের আতঙ্ক তিন গ্রামে

আড়াইহাজারের চরলক্ষ্মীপুরে মেঘনার ভাঙনে ভাঙছে তীর। ছবিটি সম্প্রতি তোলা  সমকাল

সফুরউদ্দিন প্রভাত, আড়াইহাজার (নারায়ণগঞ্জ)

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৪ | ০০:৪৯

আড়াইহাজারের কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নে নতুন করে মেঘনায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে জমি ও ঘরবাড়ি হারানোর ভয়ে দিন কাটছে এ ইউনিয়নের তিনটি গ্রাম ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের।
এর আগে নদীতে সবকিছু হারিয়ে অনেকেই এখন নিঃস্ব। এমন ভাঙনরোধে আগাম কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করছেন এলাকার মানুষ। 
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার সবচেয়ে দুর্গম ইউনিয়ন কালাপাহাড়িয়া। উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে ইউনিয়নটিকে বিচ্ছিন্ন করে বয়ে গেছে মেঘনা নদী। মেঘনার তীরঘেঁষা তিনটি গ্রাম মধ্যারচর, চরলক্ষ্মীপুর ও বিবিরকান্দী ভাঙনের কবলে পড়েছে। কয়েক বছর ধরে মধ্যারচর ও চরলক্ষ্মীপুর গ্রামের খুব কাছেই নদী থেকে বালু তোলায় অনেক আগে থেকেই গ্রাম দুটি ভাঙনের মুখে পড়েছে। এখনও প্রতিদিন কিছু কিছু অংশ ভাঙছে। এরই মধ্যে চরলক্ষ্মীপুর নজরুল ইসলাম বাবু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। স্কুলটি ডেঙ্গুরকান্দি আশ্রয়ণ প্রকল্পে সাময়িকভাবে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। সেই আশ্রয়ণ প্রকল্পটিও নদীতে বিলীন হওয়ার পথে। তীর ভাঙতে ভাঙতে মধ্যারচরের গুদারাঘাটসংলগ্ন যাত্রী ছাউনিটির খুব কাছে চলে এসেছে নদী।
কালাপাহাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা মহিতুল ইসলাম হিরু বলেন, কয়েক বছর ধরে তাদের গ্রামঘেঁষে বয়ে যাওয়া মেঘনা নদী থেকে বলগেট দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। তারা প্রতিবাদ করেও ফল পাননি। বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেছেন। কিন্তু অবৈধভাবে বালু উত্তোলন থামেনি। যাত্রীছাউনিটি যে কোনো সময় নদীতে বিলীন হতে পারে। ভাঙন রোধে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে মধ্যারচর গ্রামও নদীতে চলে যাবে। ভিটেমাটি হারাবে শত শত পরিবার।
এ ইউনিয়নের চরলক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দা রুস্তম আলী জানান, চরলক্ষ্মীপুর গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাসহ গ্রামের লোকজন বেশ আতঙ্কের মধ্যে রাত কাটাচ্ছেন। প্রতিদিনই মেঘনার ঢেউয়ে গ্রাম ভাঙছে। মেঘনা নদী আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাছে চলে এসেছে। পানিপ্রবাহ বাড়ায় মেঘনা নদীতে বড় বড় ঢেউ সৃষ্টি হয়। এভাবে ভাঙন চলতে থাকলে সবার আগে আশ্রয়ণ প্রকল্পটি নদীতে বিলীন হবে বলে জানান তিনি।

মধ্যারচরের বাসিন্দা আবদুল বারেক বলেন, মেঘনার তীব্র ভাঙনে এলাকার অনেক বাড়িসহ ফসলি জমি যে কোনো সময় নদীতে বিলীন হতে পারে। তারা খুবই আতঙ্কের মধ্যে আছেন। নদীভাঙন রুখতে না পারলে বিলীন হয়ে যাবে ভিটেমাটি ও চাষাবাদের জমিসহ বিস্তীর্ণ এলাকা।
চরলক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রশিদ বলেন, ‘প্রায় ছয় মাস আগে নদীতে আমার বাড়িসহ প্রায় ৪০ শতাংশ বিলীন হয়ে গেছে। কোথাও বসতি গড়ার জায়গা না থাকায় ডেঙ্গুরকান্দি আশ্রয়ণ কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছি। খুব কষ্টে দিন পার করছি।’
গত তিন-চার মাসের মধ্যে একই এলাকার বাসিন্দা জালাল মিয়া বাড়িসহ ২৫ শতাংশ, বিল্লাল মিয়ার বাড়িসহ ৩৮ শতাংশ, আবদুল হক সাবের বাড়িসহ ৩৫ শতাংশ, মানিক মিয়ার বাড়িসহ ২০ শতাংশ, শাহ আলম মিয়ার বাড়িসহ ৩৩ শতাংশ, ফারুক হোসেনের বাড়িসহ ২০ শতাংশ নদীতে বিলীন হয়েছে। তাদের থাকার জায়গা না থাকায় সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছেন। 
মধ্যারচর গ্রামের শামসুল হক জানান, তিন মাস আগে তাঁর বাড়িসহ ৩০ শতাংশ ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। একই এলাকায় অন্য স্থানে বাড়িঘর তৈরি করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

ছয় মাস আগে একই এলাকার বাসিন্দা নুরুল ইসলামের পরিবারের ২৯ শতাংশ, তোফাজ্জলের ২৫ শতাংশ, সাব মিয়ার ২০ শতাংশ, পল্লিচিকিৎসক চন্দন মিয়া ও তাঁর ভাইদের ৪৫ শতাংশ, ওসমান গনি ও তাঁর ভাইদের ৬০ শতাংশ, হামিদ আলীর পরিবারের ৮৮ শতাংশ, আবদুল বারেক মিয়ার ১৮ শতাংশ ফসলি জমি মেঘনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তারা শিগগির নদীরক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে বলেন, ভাঙনরোধে ব্যবস্থা না নিলে মধ্যারচর গ্রামটি একসময় মানচিত্র থেকে মুছে যাবে।
কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম ফাইজুল ইসলাম ডালিম জানান, অনেক দিন থেকেই মেঘনা নদীতে ভাঙন শুরু হয়েছে। কয়েকটি গ্রাম ভাঙনের কবলে পড়েছে। গ্রামের মানুষ আতঙ্কে আছে। বিষয়টি তিনি উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়েছেন। 
ওই ইউনিয়নের বাসিন্দা ও আড়াইহাজার উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম স্বপন বলেন, মেঘনা নদীভাঙনের কারণে দারিদ্র্যপীড়িত এ এলাকার মানুষ সবসময় উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনযাপন করেন। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এ উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়। এরই মধ্যে কয়েক শতাধিক পরিবার তাদের ভিটেমাটি ও ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। মেঘনায় ভাঙনরোধে নদীরক্ষা বাঁধসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণে জাতীয় সংসদের হুইপ ও সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। শিগগির কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আড়াইহাজারের ইউএনও ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, তিনিও কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নে মেঘনার ভাঙনের বিষয়ে পাউবোর সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা শিগগির ভাঙনরোধে পদক্ষেপ নেবে।

আরও পড়ুন

×