খুনের ছকে ৪ জনপ্রতিনিধি

কোলাজ
সাহাদাত হোসেন পরশ
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৪ | ০০:৫৯
নরসিংদী সদর উপজেলার মেহেরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হাসানকে (৪০) হত্যার অনেক তথ্য সামনে আসছে। কিলিং মিশনে ৬টি পিস্তল ব্যবহার করা হয়। পরিকল্পিতভাবে ঘটনার রাতে মাহবুবুলকে প্রথম গুলি করেন আতাউর ভূঁইয়া। তিনি মেহেরপাড়া ইউপির ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য। হত্যা পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত আতাউরসহ চারজন জনপ্রতিনিধি জড়িত। তারা হলেন– মেহেরপাড়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আজাহার অমিত প্রান্ত, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. সেলিম ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দানিছুর রহমান দানা।
আতাউরের চাচাশ্বশুর হলেন দানিছুর। লোমহর্ষক এই মামলায় আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন সেন্টু শীল ও নোবেল মিয়া নামে দুই আসামি। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও আসামিদের জবানবন্দিতে চাঞ্চল্যকর এই মামলার আদ্যোপান্ত উঠে আসছে। হত্যা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জেলফেরত দাগি আসামি সেন্টু শীলকে কিলার হিসেবে ভাড়া করা হয়। সব মিলিয়ে এ হত্যায় ১৫-১৬ জনের সংশ্লিষ্টতা মিলেছে। এখন পর্যন্ত ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের বিদ্যুৎ নামে একজনের কাছ থেকে কিলিং মিশনের অস্ত্র সরবরাহ করেন আতাউর। তিনি নরসিংদীর কুখ্যাত অস্ত্র কারবারি। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।
নোবেলের জবানবন্দিতে উঠে আসে তাঁর ভাই রাসেল মাহমুদ গেল ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। মনোনয়ন না পেয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থী আজাহারের পক্ষে মাঠে কাজ করেন। পরে রাসেল ও আজাহার ছক কষেন সাবেক চেয়ারম্যানকে যে কোনো উপায়ে ‘সরিয়ে’ দিতে হবে। যত টাকা লাগে খরচ করবেন রাসেল ও আজাহার। ঘটনার রাতে পাঁচদোনায় সর্বশেষ একটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠক হয়েছিল মাধবদীর স্যার কেজি গুপ্ত উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেটি ‘মাসুম মোল্লা’র স্কুল নামে পরিচিত। মাসুম ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বৈঠকে চেয়ারম্যান আজাহার, আতাউর, রাসেল মাহমুদ, রনি, দানিছুর ও সেলিম ছিলেন। সেখান থেকে হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। বৈঠকের ভেতরেও রাসেল ও আজাহার বলেছিলেন, মাহবুবুলকে হত্যা করতে যত টাকা লাগে তারা দেবেন।
জবানবন্দিতে উঠে আসে, এর আগেও হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। অধিকাংশ বৈঠক হয় মাধবদীর টাটাপাড়ার একটি বাড়িতে।
গত ২৮ জুন রাত পৌনে ১২টার দিকে কর্মীদের নিয়ে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পর আতাউর প্রথমে মাহবুবুলকে লক্ষ্য করে গুলি করেন। এরপর রনি ও রাসেলও গুলি করেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়লে তাঁকে কোপাতে শুরু করেন কয়েকজন।
আগে থেকে কার্যালয়-সংলগ্ন একটি কারখানার বিপরীতে গলির মুখে দাঁড় করানো একটি বালুভর্তি ট্রাকের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন আসামিরা। ট্রাক রাস্তা পার হওয়ার সময় হামলাকারীরা বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ করেন এবং গুলি ছোড়েন। হামলাকারীদের একজন ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাহবুবুলের কান-ঘাড় বরাবর আঘাত করেন। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে তাঁর সহযোগী সাঈদ ও ফরহাদ গুলিবিদ্ধ হন।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ সময় সেখানে একটি ব্যাগে করে পিস্তল নিয়ে আসেন ইউপি সদস্য আতাউর। তিনি নোবেল, দানিছুর, রনি ও রাসেলসহ কয়েকজনের হাতে পিস্তল তুলে দেন। নিজের হাতেও একটি অস্ত্র রাখেন আতাউর। কিলিং মিশনের সদস্য নুরুর হাতে ছিল চায়নিজ কুড়াল। রেজাউল ও মাসুমের কাছে ছিল চাপাতি। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তারা সবাই রাতে ওত পেতে ছিলেন।
তদন্ত সূত্র জানায়, সর্বশেষ নরসিংদী সদর উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও আজাহার ও মাহবুবুলের মধ্যে বিরোধ ছিল। আজাহার ও আতাউর আনারস প্রতীকের প্রার্থী আবদুল বাকিরের হয়ে মাঠে ছিলেন। আর মাহবুবুল ছিলেন কাপ-পিরিচ প্রতীকের প্রার্থী আনোয়ার হোসেনের পক্ষে। ওই নির্বাচনে আনোয়ার জয়লাভ করেন। উপজেলা ছাড়াও মেহেরপাড়া ইউপি নির্বাচন ঘিরে পুরোনো বিরোধও ছিল তাদের।
আরেক আসামি সেন্টু চন্দ্র শীল জিজ্ঞাসাবাদ ও জবানবন্দিতে বলেছেন, তিনি পেশায় নাপিত। এক যুগের বেশি সময় ধরে আতাউরের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দিতেন। গেল উপজেলা নির্বাচনের আগের দিন এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে মাদক সেবনের সময় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। কারাগারে থাকার সময় নুরু ও মামুন নামে দু’জন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। তারা মাহবুবুলকে হত্যার পরিকল্পনার কথা শোনান। কিলিং মিশনের তিন দিন আগে কারাগার থেকে জামিনে বের হন সেন্টু। ঘটনার রাতে ভগীরথপুরে আসার পরপরই চেয়ারম্যান আজাহার বলেন,
‘ওরে মেরে ফেল’। এরপর মুহূর্তের মধ্যে গুলি করেন আতাউর।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে আজাহারের মোবাইলে বারবার ফোন করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। নিহতের স্বজনরা জানান, ধারালো অস্ত্রের কোপে মাহবুবুলের বাঁ পাশে কানের ওপর থেকে ঘাড় পর্যন্ত ৮ ইঞ্চির মতো গভীর ক্ষত হয়। ময়নাতদন্তের সময় তাঁর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পাঁচটি গুলি পাওয়া গেছে।
মামলার বাদী ও নিহতের ছোট ভাই হাফিজুল হাসান সমকালকে বলেন, হত্যায় জড়িত মূল আসামিরা এখনও গ্রেপ্তারের বাইরে। যে স্কুলে সর্বশেষ গোপন বৈঠক হয় সেটির প্রধান শিক্ষকও আমাদের সন্দেহের তালিকায়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নরসিংদী ডিবির ওসি খোকন চন্দ্র সরকার বলেন, চাকরিজীবনে এমন লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের কাহিনি
আগে শুনিনি। আসামিরা মনে করছে, মানুষ মারা ডাল-ভাত।
- বিষয় :
- খুন