ঢাকা শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫

‘যদি মারা যাই, বিজয়ের পতাকা কবরে দিও’

‘যদি মারা যাই, বিজয়ের পতাকা কবরে দিও’

মো. সাগর গাজী

 মুফতী সালাহউদ্দিন, পটুয়াখালী 

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৪ | ০৬:২৯

‘আজ যদি আমি মারা যাই, বিজয়ের পর আমার কবরের পাশে পতাকা দিও। হয়তো লাশ হবো, নয়তো ইতিহাস হবো।’ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার আগের দিন গত ৪ আগস্ট তাঁর নিজের ফেসবুকে এমন স্ট্যাটাস দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী এইচএসসি পরীক্ষার্থী মো. সাগর গাজী (২০)। কিন্তু দুর্বৃত্তদের গুলিতে শেষ পর্যন্ত তাঁকে লাশই হতে হলো। বিজয়ের আনন্দ করতে না পারলেও তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী কবরের পাশে স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

সাগরের ইচ্ছা ছিল, লেখাপড়া করে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে মা-বাবার কষ্ট দূর করবে। কিন্তু একটি বুলেট নিমেষেই সব তছনছ করে দেয়। ছেলেকে হারিয়ে মা শাহিদা বেগম এখন পাগলপ্রায়। কিছুক্ষণ পরপরই কবরের পাশে গিয়ে অঝোরে চোখের জল ফেলছেন এবং বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। ছেলেকে হারিয়ে বাবা সিরাজুল গাজী এখন নির্বাক।

গত ৫ আগস্ট বেলা আড়াইটা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ঢাকাসহ সারাদেশে ছাত্র-জনতার বিজয় উল্লাস শুরু হয়। রাজধানীর উত্তরায় বিজয় মিছিলে যোগ দেন পটুয়াখালীর গলাচিপার সন্তান সাগর গাজী। বিকেল ৩টার দিকে সাদা পোশাকধারী কিছু সশস্ত্র লোক ফ্লাইওভারের ওপর উঠে বিজয় মিছিলে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এ সময় একটি গুলি সাগরের মাথার পেছন থেকে ঢুকে সামনে দিয়ে বের হয়ে যায়। মুমূর্ষু অবস্থায় পার্শ্ববর্তী একটি হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। ওই দিন রাতেই সাগরের মরদেহ গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার পূর্ব পাড় ডাকুয়া এলাকায় নিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

সিরাজুল দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে সাগর ছিলেন কনিষ্ঠ। গলাচিপার উলানিয়া হাট মাধ্যমিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেন এবং ওই কলেজ থেকেই এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। আন্দোলনের কারণে পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় তিনি ঢাকার উত্তরায় চাচার বাসায় বেড়াতে যান এবং সেখানে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন। তাঁর বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করে যা পান, তা দিয়ে সংসার চলে। বড় ছেলে সুজন গাজী এইচএসসি পাস করে একটি কোম্পানিতে চাকরি করে সংসারের জোগান দেন। মেজ ছেলে শাওন গাজী ঢাকার টঙ্গী সরকারি কলেজে ডিগ্রিতে লেখাপড়া করছেন। তবে সাগরকে নিয়েই পরিবারের ছিল বড় স্বপ্ন। তিনি প্রকৌশলী হয়ে পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটাবেন। 

সাগরের বাবা সিরাজুল গাজী বলেন, ‘যারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে, আমি তাদের ফাঁসি চাই। এতে পরানডা শান্তি পাবে, সাগরের আত্মা শান্তি পাবে। আমার ছেলের ইচ্ছা ছিল, সে ইঞ্জিনিয়ার হবে। আমি বলেছি, বাবা, তোকে আমি ইঞ্জিনিয়ার পড়াব। যতই গরিব হই না কেন, আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করব। কিন্তু আজ সব তছনছ হয়ে গেছে।’ 

সাগরের মা শাহিদা বেগম বলেন, ‘পুতে আমারে কয়, মা, তোমাগো বেশি দিন আর কষ্ট করা লাগব না। আমি লেখাপড়া কইরা ইঞ্জিনিয়ার হইব এবং চাকরি কইরা তোমাগো স্বপ্ন পূরণ করব। স্বপ্ন পূরণের আগেই আমার পুতে চইল্যা গ্যালো। আল্লাহ, তোমার কাছে বিচার দিলাম, আমার পুতেরে যারা গুলি কইরা হত্যা করল, তুমি তাগো কঠিন শাস্তি দিও।’ 

তাঁর বড় ভাই সুজন গাজী বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে গেছেন। তারপরও কেন গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করল? আমরা এসব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’ 

এ প্রসঙ্গে পটুয়াখালী জেলা সুজনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মানস কান্তি দত্ত বলেন, মানুষ হিসেবে কোনো হত্যাকাণ্ডই কাম্য নয়। সব হত্যার সুষ্ঠু এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তি হওয়া উচিত। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা হতাহত হয়েছেন, ওই সব পরিবারের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। 

আরও পড়ুন

×