কয়রার নারায়ণপুর দোয়ানি জলমহাল
সরকারের পতনে পলায়ন, বিএনপি হয়ে ফিরে দখল
কয়রা উপজেলার নারায়ণপুর দোয়ানি জলমহাল
শেখ হারুন অর রশিদ, কয়রা (খুলনা)
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৯:২১
চাচা আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান। সেই প্রভাব খাটিয়ে একটি মৎস্যজীবী সমিতির ইজারা নেওয়া খাল অবৈধভাবে দখল করেছিলেন তিনি। কিছুদিন না যেতেই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। সেই সময় দখলদারিত্ব ফেলে পালিয়ে গেলে আগের ইজারাদার খালটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন। কয়েক দিন পর ভোল পাল্টিয়ে বিএনপি কর্মীদের নিয়ে সেই খাল ফের দখল করেছেন তিনি।
এমন অভিযোগ উঠেছে খুলনার কয়রা উপজেলার নারায়ণপুর দোয়ানি জলমহাল নিয়ে। ৯১ একর আয়তনের জলমহালটি প্রকৃত ইজারাদারকে হটিয়ে দখল করেন বাগালি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ গাজীর ভাতিজা জাহাঙ্গীর আলম। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে পালিয়ে যান তিনি। এর আগে জড়িত ছিলেন যুবলীগের রাজনীতিতে।
খালের মূল ইজারাদার দাবি করা গাজীনগর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি মুজিবর রহমান জানান, বাংলা ১৪২৭ থেকে ১৪৩২ সাল পর্যন্ত ইজারা নিয়ে তাঁর নেতৃত্বে সমিতির সদস্যরা মাছচাষ করছিলেন। তাঁর স্বাক্ষর জাল করে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সাবলিজ চুক্তিপত্র তৈরি করেন জাহাঙ্গীর, যা নীতিমালাবহির্ভূত। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ইজারা বাতিল করিয়ে রূপসা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে ইজারা নিয়েছেন।
এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা করলে তাঁর ইজারা বাতিল করে আগের সমিতির নামে বহালের আদেশ হয়। মুজিবর রহমান বলেন, রায়ের পরও দলীয় প্রভাব খাটিয়ে খালটি দখলে রেখেছিলেন জাহাঙ্গীর। সরকার পতনের পর পালিয়ে গেলেও ফের বিএনপি নেতাকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে খালের দখল নিয়েছেন তিনি।
খালপাড়ের বাসিন্দাদের অভিযোগ, ধানচাষের জন্য খালের পানি ব্যবহার করতে জাহাঙ্গীরকে বিঘাপ্রতি ২ হাজার টাকা দিতে হয়। কয়েক বছর ধরে খালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কৃষকদের নির্যাতন করছেন তিনি। পানি ব্যবহারের অনুমতি নিতে অগ্রিম টাকা দিতে হয়। উত্তরপাড়ের বগা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল লতিফ সরদারের ভাষ্য, তিন বিঘা জমিতে চাষ করতে পানির জন্য ৬ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। অগ্রিম টাকা না দিলে পানি বন্ধ করে দেয় ইজারাদারের লোকজন। চাষাবাদে প্রতিবন্ধকতা ও খরচ বেড়ে যাওয়ায় চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে মানুষ।
১৫ বিঘা জমির জন্য ৩০ হাজার টাকা ব্যয় হয় বলে জানান খালের উত্তরপাড়ের বাঁশখালী গ্রামের ছহিল উদ্দীন সরদার। তিনি বলেন, ‘পানির সমস্যা কাটাতি পারলি স্বস্তিতে চাষাবাদ করতি পারতাম। জাহাঙ্গীর পালিয়ে যাওয়ায় মনে করিছিলাম, আর টাকা দিতি হবে না। কয়েক দিন পরে দেখি ফিরে এসেছে।’
স্থানীয় এক নারীর অভিযোগ, জাহাঙ্গীর ও তাঁর দলবলের কারণে খালপাড়ে বসবাসের পরিবেশ নেই। তাঁর লোকজনের হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন অনেক নারী। থালাবাসন ধুতে গেলেও হেনস্তা করে। চেয়ারম্যানের কাছে নালিশ নিয়ে গেলে উল্টো হেনস্তা করা হয়।
প্রায় ছয় কিলোমিটার খালের দুই পাড়ে ৬ থেকে ৭ হাজার বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষাবাদ হয় বলে জানান স্থানীয় ইউপি সদস্য আয়ুব আলী। তিনি বলেন, খালের ইজারাদার পানি বিক্রি করেই বছরে কোটি টাকা আদায় করেন। অথচ খালের বার্ষিক রাজস্ব ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। কৃষকের স্বার্থে খালটি দখলমুক্ত করা প্রয়োজন। ক্ষমতার পালাবদলে কৃষকরা স্বস্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপির কর্মী-সমর্থক নিয়ে খালটি ফের দখল করায় হতাশ তারা।
জাহাঙ্গীর আগে উপজেলা যুবলীগের সদস্য থাকলেও এখন নিজেকে বিএনপি হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। তিনি বলেন, ‘দলীয় প্রভাবে নয়, নীতিমালা অনুসরণ করেই খাল ইজারা নেওয়া হয়েছে। আগের ইজারা নীতিমালা ভঙ্গ করায় বাতিল হয়েছে। খালটি অনেক বড় হওয়ায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছেন। তাঁর চাচা বাগালি ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুস সামাদের ভাষ্য, তাঁর পরিচয়ে ভাতিজা খাল দখল করেছে, এটা সঠিক নয়। তিনি কখনও অবৈধ দখলের পক্ষে ছিলেন না।
এ বিষয়ে কয়রা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোমরেজুল ইসলাম বলেন, বিএনপির নাম ভাঙিয়ে কেউ কোনো স্থাপনা দখল করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কোনো দখলবাজকে দল প্রশ্রয় দেবে না। আর খাল দখলের অভিযোগ প্রতিনিয়ত পাচ্ছেন বলে জানান ইউএনও রুলী বিশ্বাস। তিনি বলেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতা নিয়ে সব খাল উদ্ধারে অভিযান চালানো হবে। ইজারার ক্ষেত্রে কৃষকের স্বার্থ প্রাধান্য দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
- বিষয় :
- জলমহাল দখল
- খুলনা
- কয়রা