কেনাকাটায় বাবা-ছেলের অনিয়ম
.
মিজানুর রহমান নয়ন, কুমারখালী (কুষ্টিয়া)
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৮
বিদ্যালয়ের শিক্ষক কার্যালয়ের দরজার পাশের দেয়ালে কালো রঙের বায়োমেট্রিক হাজিরা যন্ত্র স্থাপন করা। তাতে ধুলো-বালি জমে মাকড়সা বাসা বেঁধেছে। সব অচল অবস্থায় পড়ে আছে। সার্ভার যন্ত্র রাখা হয়েছে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ে। তার ওপরে কাগজের স্তূপ। গত সোমবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার পৌরসভা, যদুবয়রা, জগন্নাথপুর, সদকী, পান্টি, নন্দলালপুর ও চাপড়া ইউনিয়নের ৫৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে পাওয়া গেছে এমন চিত্র।
প্রায় পাঁচ বছর আগে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ১৪৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৭ লাখ ৯৩ হাজার টাকায় হাজিরা যন্ত্র বসানো হয়। তবে আজও সেগুলো চালু হয়নি। ফলে অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। স্লিপের টাকায় এসব যন্ত্র স্থাপনের পর এক দিনও ব্যবহার না হওয়ায় ধুলা-বালু জমে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। এসব যন্ত্র কেনায়
অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সাবেক পৌর মেয়রের নির্দেশে তাঁর ছেলের কাছ থেকে শিক্ষকরা যন্ত্রগুলো কিনতে বাধ্য হন। পরে ভুয়া ভাউচারে বিল তোলেন ছেলে।
স্লিপের টাকায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করে খরচ করতে চেয়েছিল বলে জানিয়েছেন বজরুক দুর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, ‘মেয়র ফোন দিয়ে বলেন তাঁর ছেলের কাছ থেকে নিতে।’ তাঁর ভাষ্য, মেয়রপুত্র লোক পাঠিয়ে যন্ত্র লাগিয়ে ১৯ হাজার টাকা নিয়ে গেছেন। যদিও যন্ত্রটি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় কেনা যেত।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, প্রভাব খাটিয়ে কুমারখালী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সামছুজ্জামান অরুণ তাঁর ছেলে অর্ণব কিবরিয়া প্রতীকের কাছ থেকে ‘রিয়েল টাইম ব্র্যান্ডের আরএস-২০বি’ মডেলের বায়োমেট্রিক হাজিরা যন্ত্র স্থাপনের নির্দেশ দেন। সে সময় প্রতিটি যন্ত্রের বাজারমূল্য ছিল ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। তবে প্রতীক ‘প্যাসিফিক এন্টারপ্রাইজ’ ও ‘টারডো কম্পিউটার’ নামে প্রতিষ্ঠানের ভুয়া ভাউচার ব্যবহার করে ১৯ থেকে ২০ হাজার টাকা করে বিল তুলে নিয়েছেন।
বানিয়াকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) শাহানারা পারভীনের ভাষ্য, ১৯ হাজার টাকা নিয়ে যন্ত্র স্থাপন করলেও এক দিনও চলেনি, নষ্ট। তবে কিছুটা সংশয় নিয়ে অভেদানন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাছরিন আক্তার বলেন, সহকারী শিক্ষক দ্বিপেন্দ্রনাথ পালের মাধ্যমে টারবো কম্পিউটার থেকে যন্ত্রটি তারাই কিনেছেন। স্থাপন করেছেন মেয়রের লোকজন। এ বিষয়ে সহকারী শিক্ষক দ্বিপেন্দ্রনাথ পাল বলেন, স্লিপের ২০ হাজার টাকায় যন্ত্রটি কেনা। তবে সরবরাহ করেছিল প্রতীক।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্লিপের টাকায় বায়োমেট্রিক হাজিরা যন্ত্র কেনার সিদ্ধান্ত হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে বাজার যাচাই-বাছাই করে সাশ্রয়ী মূল্যে যন্ত্র কিনে স্থাপন করবে। এর ব্যত্যয় হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ভেস্তে দেন সাবেক মেয়রের ছেলে অর্ণব কিবরিয়া প্রতীক। তিনি প্রভাব খাটিয়ে নিজের লোকজন দিয়ে যন্ত্রগুলো স্থাপন করেন।
এ জন্য ঢাকার ‘তেঁজগাও পান্থপথ’ ঠিকানা ব্যবহার করে ‘প্যাসিফিক এন্টারপ্রাইজ’ ও কুমারখালী বাসস্ট্যান্ড এলাকার ‘টারডো কম্পিউটার’ নামে প্রতিষ্ঠানের ভুয়া ভাউচার ব্যবহার করে ১৯ থেকে ২০ হাজার টাকা করে বিল তুলে নেন। ভাউচারের ঠিকানায় নিজের মোবাইল ফোন নাম্বার ব্যবহার করেছেন প্রতীক। নির্দেশনার বাইরে এভাবে কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। যন্ত্র কেনার পর এক দিনও ব্যবহার করা হয়নি। তবে এতদিনে ভয়ে কেউ মুখ খোলেননি।
‘রিয়েল টাইম কোম্পানির’ হটলাইন নম্বরে ফোন দিলে একজন কর্মকর্তা বলেন, আরএস-২০বি মডেলের বায়োমেট্রিক যন্ত্রটি এখন নেই। সে সময় প্রতিটি যন্ত্র সাড়ে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করা হতো। এ বিষয়ে কুমারখালীর টারবো কম্পিউটারের স্বত্বাধিকারী লিটন আব্বাসের ভাষ্য, তিনি কোনো দিন বায়োমেট্রিক হাজিরা যন্ত্র কেনাবেচা করেননি। তাঁর দোকানের ভাউচার নকল করে বিল করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে ‘প্যাসিফিক এন্টারপ্রাইজে’র ভাউচারে থাকা ফোন নম্বরে কল দিলে ট্রুকলার অ্যাপে নাম আসে অর্ণব কিবরিয়া। তিনি রিসিভ করে তিনি বলেন, ‘রং নাম্বার’। এরপর প্যাসিফিক এন্টারপ্রাইজ বলে কিছু নেই জানিয়ে ফোনটি কেটে দেন। পরে এটিসহ তাঁর ব্যক্তিগত নম্বরে বারবার কল দিলেও তিনি আর রিসিভ করেননি।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৪৭টি বিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক হাজিরা যন্ত্র কেনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা খন্দকার শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, স্লিপের টাকা প্রধান শিক্ষকসহ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বাজার যাচাই করে খরচ করার কথা। সে সময় কিছু ব্যত্যয় ঘটেছিল। মূলত শিক্ষক-কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে প্রতীকের রাজনৈতিক চাপে পড়ে যন্ত্রগুলো কেনেন। যাচাইয়ের সুযোগ পাননি। এতে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে।
কুমারখালীতে যোগদানের আগেই যন্ত্রগুলো স্থাপন করা হয়েছে জানিয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এগুলো কোনোদিন ব্যবহার হয়নি। অকেজো পড়ে আছে। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে সচল করা হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ
নেতা ও সাবেক মেয়র সামছুজ্জামান অরুণ। তাঁর ফোনটিও বন্ধ রয়েছে। ফলে এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
- বিষয় :
- দুর্নীতি