ঢাকা রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

টানা বর্ষণে মাছ ও কৃষিতে ক্ষতি

টানা বর্ষণে মাছ ও কৃষিতে ক্ষতি

ডুমুরিয়ার গুটুদিয়া গ্রামের রাস্তা পানিতে ডুবে যাওয়ায় নৌকায় চলাচল করছেন এলাকার মানুষ সমকাল

নড়াইল, ডুমুরিয়া (খুলনা) ও নওয়াপাড়া (যশোর) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৩:০৯

টানা বর্ষণে নড়াইল, ডুমুরিয়া ও নওয়াপাড়ার অসংখ্য গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিতে ভেসে গেছে হাজার হাজার ঘেরের মাঠ। কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসলও ডুবে গেছে। শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর ও গ্রামীণ সড়ক তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
নড়াইলে মাছচাষি ও কৃষকের অন্তত অর্ধশত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে মৎস্য ও কৃষি বিভাগ থেকে জানা গেছে। গত শুক্রবার থেকে সোমবার পর্যন্ত চার দিনের বর্ষণে জেলার ৫০০ হেক্টর জমির ৩ হাজার দেশি ও চিংড়ি মাছের ঘের ভেসে গেছে। ৩ হাজার ৬০০ হেক্টর জমির ধান, পান, কাঁচামরিচ ও শাকসবজি নিমজ্জিত হয়েছে।
কালিয়ার চাঁচুড়ী গ্রামের পংকজ রায় জানান, তিনি চাঁচুড়ী বিলে ৩ একরের দুটি ঘেরে প্রায় ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। বৃষ্টিতে ঘের ভেসে গেছে। নেট দিয়েও কাজ হয়নি। সদরের তুলারামপুর গ্রামের সাজ্জাদ হোসেনের ভাষ্য, পরপর দু’বার বৃষ্টিতে এলাকার প্রায় ২০০ একর জমির আউশ ও আমন ধানক্ষেত তলিয়ে গেছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এইচ এম বদরুজ্জামান বলেন, বৃষ্টিতে জেলায় প্রায় ৬০ কোটি টাকার সাদা ও চিংড়ি মাছ ভেসে গেছে। তবে ঘের ভেসে গেলেও কিছু মাছ থেকে যায়। আবার কিছু অন্য ঘের থেকেও আসে। আর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আশেক পারভেজের ভাষ্য, ধান, পান, মরিচ ও শাকসবজি পানিতে নিমজ্জিত হলেও রোদ হলে ক্ষয়ক্ষতি কমবে। সে কারণে কৃষিতে ক্ষতির পরিমাণ এখনও নিরূপণ করা যায়নি।
দুই সপ্তাহের বর্ষণে ডুমুরিয়ার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে দেড় লক্ষাধিক মানুষ। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, উপজেলায় পাউবোর ৯টি পোল্ডারে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ১০১টি স্লুইসগেটের মধ্যে ৭৫টি অকেজো। ১৩৫টি সরকারি নদী ও খালে মাছ চাষ করছেন প্রভাশালীরা। ফলে পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় শুরু হয় জলাবদ্ধতা। উঁচু আশ্রয়স্থল খুঁজছে মানুষ। মাছচাষি ও কৃষক বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
এলাকার মাছের ঘের, পুকুর, সবজির ক্ষেত, ঘরবাড়ি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর, গ্রামীণ সড়কও পানির নিচে। রুদাঘরার ব্যবসায়ী শাহাজান হুসাইনের ভাষ্য, নদী-খালে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে প্রভাশালীরা মাছ চাষ করছেন। দখলদারদের বিরুদ্ধে কথা বললে মূল্য দিতে হয়। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। চাষি কেরামত আলী পাঁচ বিঘা জমিতে মাছ চাষ করেছিলেন। সব ভেসে যাওয়ায় ৭ লাখ টাকার ক্ষতির আশঙ্কা তাঁর।
উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ১৮ হাজার ৭১২টি ঘের থেকে মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ হাজার ১৯০ টন। চাষিদের আয় হতো ১ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। তবে ১০ হাজার ঘের এবং ৩ হাজার পুকুর তলিয়ে মাছ ভেসে গেছে। এতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্ধেকে নেমে আসতে পারে। আর কৃষি কর্মকর্তা ইনসাদ ইবনে আমিন বলেন, ৫ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়েছে। উৎপদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার টন। যার মূল্য ৫৪৬ কোটি টাকা। তবে ৩ হাজার হেক্টর তলিয়ে গেছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আশরাফ হোসেন বলেন, উপজেলার টোলনা গ্রামে মাটির দেয়াল চাপা পড়ে ইশানুর বিশ্বাস নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। প্রায় দেড় হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে। উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি) মো. রবিউল ইসলাম বলেন, সদরসহ বিস্তীর্ণ এলাকার গ্রামীণ সড়ক তলিয়ে গেছে। শতকোটি টাকার ক্ষতি আশঙ্ক করা হচ্ছে।
খুলনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রহমান তাজকিয়া বলেন, নদী ও খাল খনন চলমান রয়েছে। স্লুইসগেটগুলো সংস্কারের উদ্যেগ নেওয়া হয়েছে। তবে বরাদ্দ অপ্রতুল। ইউএনও মুহাম্মদ আল আমিনের ভাষ্য, পানি নিষ্কাশনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে বাঁধ কেটে দেওয়া হয়েছে। সরকারি নদী-খাল অবৈধ দখলমুক্ত করা হবে।
নওয়াপাড়ায় বৃষ্টিতে প্রায় ৪০টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। বাড়িঘর, স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট, ধর্মীয় উপাসনালয় তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে সহস্রাধিক মাছের ঘের, পুকুর ও ফসলি জমি। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ। যাতায়াতে নৌকাই একমাত্র ভরসা। উপজেলা প্রশাসন ১৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে। 
উপজেলার বেদভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নুর ইসলাম বলেন, বিদ্যালয়ের মাঠে ও বারান্দায় পানি উঠেছে। ডুমুরতলা গ্রামের মিলন মণ্ডলের ভাষ্য, ১৫৫টি বাড়ির উঠানে ১ থেকে ২ ফুট পানি উঠেছে। কয়েকটি ঘরেও পানি ঢুকেছে। চলিশিয়া ইউপি চেয়ারম্যান সানা আবদুল মান্নান বলেন, জলাবদ্ধতায় তাঁর ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সরকারি সহায়তা মেলেনি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোসা. লাভলী খাতুন জানান, আমনের ১ হাজার ৫৮১ হেক্টর, ১৩৬ হেক্টর সবজি, পেঁয়াজ ১৫ এবং ৬ হেক্টর ক্ষেতের মরিচ তলিয়ে গেছে। মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল হক জানান, তিন ইউনিয়নে ১২০ হেক্টর জমির ৩২০টি মাছের ঘের ভেসে গেছে। ক্ষতির প্রায় ৫ কোটি টাকা। যশোর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ ব্যানার্জী বলেন, হরি নদীতে ২ দশমিক ১ কিলোমিটার মাটি কাটার কাজ চলছে। ভবদহে চারটি বড় ও পাঁচটি ছোট পাম্প চলছে। তবে বিদ্যুতের সমস্যা হচ্ছে। বৃষ্টি না হলে দ্রুত পানি সরানো সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন

×