ঘুষ ছাড়া বিল দেন না শিক্ষা কর্মকর্তা

প্রতীকী ছবি
আসাদুজ্জামান আসাদ, শিবপুর (নরসিংদী)
প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০০:১০
শিবপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোসা. তাজমুন্নাহারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও শিক্ষকদের হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। নিয়মিত অফিস করেন না তিনি। প্রতি বৃহস্পতিবার সকালে অফিসে হাজিরা দিয়েই ঢাকায় চলে যান। আবার রোববার দিন ১১-১২টার দিকে অফিসে আসেন।
নিয়মিত অফিস না করার কারণে তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন নরসিংদী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম। চিঠিতে বলা হয়েছে, বিনা অনুমতিতে গত ১১ আগস্ট অফিসে অনুপস্থিত থাকায় দাপ্তরিক কাজ করতে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর কেন সুপারিশ করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
শিবপুর উপজেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৪২টি বিদ্যালয়ে স্লিপ বাবদ ৪২ লাখ ৮০ হাজার টাকা, ৬৫টি বিদ্যালয়ে ওয়াশব্লক বাবদ ১৩ লাখ ১০ হাজার টাকা, ৩০টি বিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র মেরামত বাবদ ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি বিদ্যালয়ের কাজ সম্পন্ন করে বিল পাসের ছাড়পত্র দেন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তারা। এর পর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার চূড়ান্ত ছাড়পত্রে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বিল-ভাউচার যাচাই-বাছাই করে প্রতিটি বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবে টাকা পাঠান। আর ক্ষুদ্র মেরামত ও ওয়াশব্লকের টাকা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাবে জমা করেন। তবে এ টাকা তুলতে পারছেন না শিক্ষকরা। কারণ শিক্ষা কর্মকর্তা তাঁর প্রত্যয়ন ছাড়া টাকা দিতে নিষেধ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ম্যানেজারকে। ক্ষুদ্র মেরামত ও ওয়াশব্লকের চেকও দিচ্ছেন না।
অভিযোগ রয়েছে, শিবপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোসা. তাজমুন্নাহারের নিয়োগ দেওয়া ৩-৪ জন প্রধান শিক্ষক রয়েছেন। তাদের মাধ্যমে তিনি অবৈধ লেনদেন করে থাকেন। তিনি কারও ফোন ধরেন না। বাধ্য হয়ে শিক্ষকরা বিদ্যালয় ফেলে তাঁর অফিসে ভিড় করেন। তিনি বিল-ভাউচার অনুমোদনের জন্য ঘুষ নিয়ে থাকেন। এ ছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার গোল্ড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের ইউনিয়নভিত্তিক বরাদ্দের ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষা কর্মকর্তা মোসা. তাজমুন্নাহার ক্ষুদ্র মেরামতের বরাদ্দ থেকে ১০ হাজার টাকা, স্লিপ ও ওয়াশব্লক থেকে ২ হাজার টাকা করে ঘুষ নেন। চাহিদামতো যারা টাকা দেন, তাদের প্রত্যয়ন ও চেক দেন। প্রধান শিক্ষকদের গত অর্থবছরের যাতায়াত বাবদ বিল করার জন্য ২০০ টাকা করে তুলে আত্মসাৎ করেছেন শিক্ষা কর্মকর্তা। এসব জানাজানি হলে শিক্ষকরা মানববন্ধন করতে চাইলে তড়িঘড়ি করে প্রধান শিক্ষকদের তাঁর অফিসে ডেকে নেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ধানুয়া ক্লাস্টারের ১২ প্রধান শিক্ষক। তাদের কাছ থেকে ঘুষ না নেওয়ার একটি প্রত্যয়ন নেন তিনি। গত আগস্ট মাসে প্রধান শিক্ষকদের মাসিক সমন্বয় সভায় শিবপুর উপজেলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. হানিফসহ কয়েকজন প্রধান শিক্ষক শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হয়রানি, নিয়মিত অফিস না করা, ফোন না ধরা ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করেন। এ সময় উপস্থিত ১৪২ প্রধান শিক্ষক তাদের প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। তখন শিক্ষা কর্মকর্তা মোসা. তাজমুন্নাহার সভায় জানান, প্রকল্পের টাকা নিয়ে শিক্ষকদের আর হয়রানি করা হবে না। এর পরও তাঁর অবস্থান পরিবর্তন হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রধান শিক্ষক জানান, শিক্ষা কর্মকর্তা ঘুষ ছাড়া প্রকল্পের টাকা দিচ্ছেন না। টাকা না দিলে হয়রানি করছেন।
শিবপুর উপজেলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. হানিফ, শিবপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ কে এম মাসুদুর রহমান খান, যোশর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনির হোসেন জানান, শিক্ষা কর্মকর্তা প্রকল্পের টাকা নিয়ে শিক্ষকদের হয়রানি করছেন। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের টাকা তাদের কাউকে দেওয়া হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল খেলার টাকা আমাদের কাউকে দেননি।’
শিবপুর উপজেলা সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলামের ভাষ্য, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোসা. তাজমুন্নাহার ছাড়পত্র ছাড়া কাউকে টাকা দিতে নিষেধ করেছেন। যারা তার ছাড়পত্রের প্রত্যয়ন নিয়ে আসেন, শুধু তাদেরই টাকা দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ১৪২টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪০-৫০টির টাকা নেওয়া হয়েছে।
তবে শিক্ষা কর্মকর্তা মোসা. তাজমুন্নাহারের দাবি, তাঁর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা। নিয়মিত অফিস করছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের টাকা ক্লাস্টার এটিওদের কাছে আছে।
নরসিংদী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ওই শিক্ষা কর্মকর্তার বিষয় নিয়ে শিবপুর থেকে ৫-৬ জন শিক্ষক আমার কাছে এসেছিলেন। বিষয়টি আমি দেখছি।’
এর আগে ঢাকার ধামরাই উপজেলার দায়িত্বে ছিলেন শিক্ষা কর্মকর্তা মোসা. তাজমুন্নাহার। সেখানেও তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। যে কারণে ২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বিভাগীয়
মামলার শুনানিতে উপস্থিত থাকার জন্য তাঁকে নোটিশ দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত ও শৃঙ্খলা শাখার তৎকালীন উপসচিব ফারহানা হক। পরে তাঁকে শাস্তিমূলক শিবপুর উপজেলায় বদলি করা হয়।
- বিষয় :
- ঘুষ