চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন কি পূরণ হবে না হাসিবের

মো. হাসিব
জাকির হোসেন, আমতলী (বরগুনা)
প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৩:৩৫
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর ডান হাত অচল হয়ে গেছে। মেধাবী ছাত্রটির পরিবার তাঁর লেখাপড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে।
আমতলী উপজেলার আরপাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের পূর্ব চরকগাছিয়া গ্রামের আবুল বাশার ও মাহমুদা দম্পতির বড় ছেলে মো. হাসিব। তিনি এ বছর ঢাকার তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পরীক্ষা দিয়েছেন। ২০২২ সালে তিনি আমতলী বন্দর হোসাইনিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা থেকে বিজ্ঞান শাখায় জিপিএ ৫ পেয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন। কামিল পরীক্ষায়ও জিপিএ ৫ পাবেন বলে আশা করছেন তিনি। হাসিবের স্বপ্ন চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু পুলিশের গুলিতে ডান হাত অচল হয়ে যাওয়ায় তাঁর স্বপ্ন আদৌ পূরণ হবে কিনা– জানেন না হাসিব।
দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে হাসিব যোগ দেন। ১৮ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে কয়েক হাজার ছাত্র উত্তরা বিএনএস সেন্টার থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলে মিছিলে পুরো উত্তরা বিএনএস সেন্টার যখন কেঁপে ওঠে, পুলিশ মারমুখী হয়ে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় একটি গুলি এসে হাসিবের শ্বাসনালির ডান পাশে লাগে। গুলিটি গলা ভেদ করে ডান ঘাড়ের পেছনের মাংশপেশি ছিঁড়ে বের হয়ে যায়। এ সময় হাসিব অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্ররা এবং তাঁর ক্লাসের বন্ধু হোসাইন আলম তাঁকে ধরাধরি করে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তাঁর অবস্থার আরও অবনতি হলে রাত ৯টার দিকে নেওয়া হয় পঙ্গু হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসার একদিন পর তাঁর জ্ঞান ফেরে। সেখানে চার দিন থাকার পর রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় চিকিৎসকরা তাঁকে ছাড়পত্র দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। এ অবস্থায় বাড়ি ও হাসপাতালে মাসাধিককাল চলে তাঁর চিকিৎসা। চিকিৎসায় গলার সামনের অংশ শুকালেও পেছনের ঘা এখনও শুকায়নি। গুলিতে ঘাড়ের রগ ছিঁড়ে যাওয়ায় ডান হাতটি অচল হয়ে গেছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে হাসিব বলেন, ‘সেদিন দাবি আদায়ের জন্য রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছি। এর বেশি কোনো অপরাধ করিনি। কিন্তু পুলিশ আমাদের আন্দোলন দমন করার জন্য নির্বিচারে গুলি চালায়। ১৮ জুলাই বিকেলে আমরা প্রায় কয়েক হাজার ছাত্র উত্তরা বিএনএস সেন্টারের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে বের হই। পুলিশ মিছিলে আমাদের ওপর গুলি চালায়। পুলিশের ছোড়া একটি গুলি আমার গলার ডান পাশে লেগে পেছনের ঘাড়ের নিচ দিয়ে বের হয়ে যায়। এর পর আমি আর কিছুই বলতে পারি না। পরদিন যখন আমার জ্ঞান ফেরে, তখন পঙ্গু হাসপাতালের বিছানায়। যেভাবে আমার গলায় গুলি লেগেছে, তাতে আমি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি। বাঁচার কোনো আশা ছিল না। আমার বন্ধুবান্ধব, বাবা-মা কেউ ভাবেনি আমি বেঁচে ফিরব। তবে এখন আমি পঙ্গু হয়ে গেছি। ডান হাত দিয়ে কাজ করা তো দূরের কথা, কিছু লিখতেও পারি না। রাতে ঘুমাতে পারি না, যন্ত্রণায় শুধু ছটফট করি। জানি না, আমার হাত আদৌ ভালো হবে কিনা। যদি ভালো না হয়, তাহলে আমার সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম চিকিৎসক হব। কিন্তু যদি লিখতে না পারি তাহলে কীভাবে ভর্তি পরীক্ষা দেব। আমি এখন পুরো হতাশ।’
হাসিবের বন্ধু হোসাইন আলম বলেন, শুরু থেকেই হাসিবসহ তারা সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশ নেন। ঘটনার দিন যেভাবে হাসিবের গলায় গুলি লেগেছে, তাতে তাঁর বাঁচার কথা ছিল না।
হাসিবের মা মাহমুদা বেগমকে ছেলের কথা জিজ্ঞেস করতেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘আমার এক ছেলে এক মেয়ে। হাসিব বড়। মেয়েডারে বিয়া দিছি। পোলায় ডাক্তার অইতে চায়। এহন পুলিশের গুল্লি খাইয়া মরনের ধাইরদা আইছে। মোরা কেউ ভাবি নাই ও বাঁচপে। আল্লায় হগগুলডির দোয়ায় অরে বাঁচাইয়া রাখছে। তয় বাঁচলে কী অইবে। ডাইন হাতটা পঙ্গু অইয়া গ্যাছে। অর আশা ছিল ডাক্তার অইবে। এহন ল্যাখতে না পারলে ক্যামনে ডাক্তার অইবে।’
হাসিবের বাবা আবুল বাশার বলেন, ‘আমার ছেলে দেশের মঙ্গলের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রায় মারা গেছিল। অল্লায় বাঁচাইছে। বাঁচলেও ছেলেটার ডান হাত এখন পঙ্গু হয়ে গেছে। আমার ছেলেকে যারা পঙ্গু করছে, বর্তমান সরকারের কাছে তাদের বিচার চাই।’
- বিষয় :
- বরগুনা