ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বিভিন্ন তেলের পাম্প, ডিপো ও বেসরকারি রিফাইনারি থেকে মাসোহারা আদায়

বয়স চুরি, ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দিয়েও বিপিসিতে রাজত্ব

ফাইল ফটো

তৌফিকুল ইসলাম বাবর, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০৮:৫৫

বয়স ‘চুরি’ ও ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দিয়ে চাকরি শুরু। এর পর একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতি। দ্রুতই বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) এই কর্মকর্তার নাম মোরশেদ হোসাইন আজাদ। প্রতিষ্ঠানটির উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) তিনি। মাঝে কিছুদিন অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন বিপিসিরই বিপণন প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমেটেডে (এসএওসিএল)। 

বিপিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ, দায়িত্বভার গ্রহণের পর আজাদের স্বেচ্ছাচারী ও একগুঁয়েমি সিদ্ধান্তে প্রতিষ্ঠান নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। আর ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। ফলে কর্মস্থলে ইচ্ছেমতো প্রভাব খাটিয়েছেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন মোরশেদ হোসাইন আজাদ। ২০০৯ সালে বিপিসির উপব্যবস্থাপক (বিপণন) পদে বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে তিনি নিয়োগ পান। এই নিয়োগে তিনি জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিজ্ঞপ্তিতে সংশ্লিষ্ট কাজে আট বছরের অভিজ্ঞতাসহ বয়স চাওয়া হয় অনূর্ধ্ব ৩৩ বছর (৩১.০৩.২০০৯ পর্যন্ত)। কিন্তু মোরশেদ হোসাইন আজাদ যখন নিয়োগ পান তখন তাঁর বয়স ছিল ৩৩ বছর ৪ মাস ২১ দিন। অভিজ্ঞতা হিসেবে গ্লোয়ার ট্রেডিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সনদ দেওয়া হয়। পরে অডিটে বিষয়টি ভুয়া হিসেবে ধরা পড়ে এবং এ নিয়ে অডিট আপত্তি উত্থাপন করা হয়। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে এসব অভিযোগ গোড়াতেই থামিয়ে দেন আজাদ।

২০২১ সালের ৫ ডিসেম্বর বিপিসির বিপণন প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের মোংলা অয়েল ইন্সটলেশনের তখনকার ব্যবস্থাপক (পরিচালন) একেএম জাহিদ বিপিসির ডিজিএম মোরশেদ হোসাইন আজাদের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে দুদকে একটি চিঠি দেন।  দুদক নিজে তদন্ত না করে বিপিসির সচিবকে তদন্তভার দেয়। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন আর আলোর মুখ দেখেনি। 

দুদকে দেওয়া অভিযোগে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের বিষয়টি নিশ্চিত হতে তাঁর এবং তাঁর ভাতিজা ও ছোট ভাইয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন পাম্প ও তেলের ডিপো থেকে নমুনা সংগ্রহ করে এবং তেলে ভেজাল দেওয়ার অভিযোগসহ বিভিন্ন অজুহাতে ঘুষ আদায় করেন তিনি। বেসরকারি একুয়া রিফাইনারি থেকে প্রতি মাসে দুই লাখ টাকা ও সুপার রিফাইনারি থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে ঘুষ নেন। এ ছাড়া পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের দৌলতপুর ডিপো থেকে মাসোহারা নিয়ে থাকেন তিনি। তাঁর ছোট ভাই মো. ফারুকের মোবাইল নম্বর ও এসএ পরিবহনের মাধ্যমে তিনি ১৫ লাখ টাকা মাসোহারা নেন। 
দুদকের কাছে আজাদের সম্পদের চিত্রও তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরীর উত্তর আগ্রাবাদের মোল্লাপাড়ায় অবস্থিত নিরিবিলি আবাসিক এলাকায় প্রায় ১৬ শতাংশ জায়গার ওপর ছয়তলা আবাসিক ভবন নির্মাণ করেন। নগরীর কালামিয়া বাজার এলাকায় প্রায় ২৪ শতাংশ মূল্যবান জায়গা কেনেন। নগরীর লালখান বাজারে অবস্থিত আমি সেন্টারে তাঁর রয়েছে বড় একটি দোকান।

দুদকে দেওয়া চিঠির বিষয়ে কথা বলতে একেএম জাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। অনেকবার চেষ্টা করা হলেও তাঁর ফোনও রিসিভ হয়নি।
তবে উত্তর আগ্রাবাদের নিরিবিলি আবাসিক এলাকায় গিয়ে মোরশেদ হোসাইন আজাদের ভবনের খোঁজ পাওয়া গেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভবনটি নির্মাণ করেন আজাদ। ভবনের একাধিক ভাড়াটিয়া জানান, বিপিসির ডিজিএম মোরশেদ হোসাইন আজাদ নিজেই ভবনটির সার্বিক বিষয় দেখাশোনা করেন।

কিছু দিন আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টার কাছে মোরশেদ হোসাইন আজাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে আরও একটি অভিযোগ জমা পড়ে। এতে বলা হয়, বিপিসির আওতাধীন এসএওসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থাকাকালীন আমদানিকৃত লুব বেইস অয়েলের কাঁচামাল বিপিসি নির্ধারিতের চেয়ে কমমূল্যে বিক্রি করে দিয়ে লাভবান হন তিনি। লুব বেইস অয়েলের বিপিসি নির্ধারিত মূল্য লিটার ১১৭ টাকা ৮০ পয়সা হলেও তিনি তা বিক্রি করেন ১০৯ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি লিটারে ৮ টাকা ৮০ পয়সা কম দামে তিনি এই জ্বালানি তেল বিক্রি করে দেন। এভাবে প্রায় দুই হাজার টন লুব অয়েল বিক্রির ফলে কোম্পানির ক্ষতি হয় প্রায় দুই কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রতি ড্রাম বিটুমিনের বাজারমূল্য সাত হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু ছয় হাজার ৮৬৩ ড্রাম বিটুমিন তিনি বিক্রি করেন এক হাজার ৮০০ টাকা দরে। দুই দফায় পানির দরে বিটুমিন বিক্রি করে দেওয়ায় কোম্পানির প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার লোকসান হয়। 

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে এসএওসিএলের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা সমকালকে জানিয়েছেন, এসএওসিএলের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিপিসি। তাই মোরশেদ হোসাইন আজাদের অনেক অনিয়ম, একগুঁয়েমি সিদ্ধান্ত ও স্বেচ্ছাচারিতা তাদের মুখ বুঝে সহ্য করতে হয়েছে। লুব বেইস অয়েল, বিটুমিন ও স্ট্রিল স্ট্রাকচারসহ বিভিন্ন পণ্য ও জিনিস বিক্রি করে তিনি নিজে লাভবান হলেও প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

যা বললেন মোরশেদ হোসাইন আজাদ: চাকরিতে কৌশলে বয়স কমানো প্রসঙ্গে মোরশেদ হোসাইন আজাদ দাবি করেন, ‘নিয়োগ কমিটি পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই করে তাঁর নিয়োগ পরীক্ষার চিঠি ইস্যু করেছে। তাই বয়স কমানোর বিষয়টি সত্য নয়।’ বিভিন্ন পাম্প, ডিপো, বেসরকারি রিফাইনারি থেকে অর্থ আদায়ের বিষয়ে তাঁর ভাষ্য, ‘আমি তেলে ভেজাল বন্ধে কাজ করেছি। অনেক পাম্প বন্ধ করে দিয়েছি। যদি টাকা নিতাম তাহলে এগুলো তো বন্ধ করতাম না।’ 

এসএওসিএলের স্টিল স্ট্রাকচার, গাড়ি, বিটুমিন ও লুব অয়েল কম দামে বিক্রি করে দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস্ত করা ও নিজে লাভবান হওয়া নিয়ে বিপিসির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিটুমিন ও লুব অয়েলগুলো দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। আমি উদ্যোগ নিয়ে বোর্ডের অনুমোদনক্রমে সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে এগুলো বিক্রি করেছি। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে এটা করেছি।’  

ছাত্রলীগের পদে থাকার বিষয়টি আজাদ স্বীকার করেছেন। তিনি সমকালকে বলেন, ‘ছাত্রজীবনে রাজনীতি করলেও কখনও সেই প্রভাব আমি কর্মস্থলে খাটাইনি। যোগ্যতা দিয়ে কাজ করেছি।’  

আরও পড়ুন

×