বন্ধকি জমি বিক্রি আ’লীগ নেত্রীর, ৩৮ বছর পর হুঁশ ব্যাংকের

.বরিশাল নগরীর ২৮ শতক জমি সোনালী ব্যাংকে বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছিলেন পটুয়াখালী আওয়ামী লীগ নেত্রী জাকিয়া সুলতানা বেবী। ছবি: সমকাল
সুমন চৌধুরী, বরিশাল
প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৩৭ | আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪ | ১৩:৪৯
বরিশাল নগরীর ২৮ শতক জমি সোনালী ব্যাংকে বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছিলেন পটুয়াখালী আওয়ামী লীগ নেত্রী জাকিয়া সুলতানা বেবী। ১৯৮৫ সালে নেওয়া ২ কোটি ২৩ লাখ ২৪ হাজার টাকার সেই ঋণ আর শোধ করেননি। সুদাসলে তা এখন দাঁড়িয়েছে ৮৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। পটুয়াখালী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের সাধারণ সম্পাদক জাকিয়া এর মধ্যে বন্ধকি জমি বিক্রিও করে দিয়েছেন। ৩৯ বছরের মাথায় এসে পটুয়াখালী সোনালী ব্যাংক এখন বলছে– তারা নাকি এ খবর জানতই না। জমি ফিরে পেতে তাই মামলা করেছে।
জানা গেছে, পটুয়াখালী শহরের বিসিক শিল্প এলাকায় ১৯৮৫ সালে ‘পটুয়াখালী টেক্সটাইল মিল লিমিটেড’ নামে প্রতিষ্ঠান করেন জাকিয়া ও তাঁর স্বামী সিরাজুল ইসলাম। এর ৭৫ ভাগ মালিকানা ছিল প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিরাজুলের এবং বাকি ২৫ শতাংশ পরিচালক হিসেবে জাকিয়ার। স্বামীর মৃত্যুর পর এখন শতভাগ মালিকানাই জাকিয়ার। কখনোই উৎপাদনে যেতে না পারা ওই প্রতিষ্ঠানের নামেই বরিশাল নগরীর জমিটি বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া হয়। তবে ২০০২ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে পাঁচটি দলিলে পুরো জমিই বিক্রি করে দিয়েছেন জাকিয়া।
বরিশালের রূপাতলী বাস টার্মিনাল থেকে পটুয়াখালীমুখী প্রায় এক কিলোমিটার গেলে সড়কের পাশেই জমিটির অবস্থান। সরেজমিন দেখা যায়, জাকিয়ার কাছ থেকে জমি কিনে পাকা ও আধাপকা ভবন নির্মাণ করেছেন মালিকরা। ভাড়াটিয়াসহ সেখানে অন্তত ২০টি পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে দিলরুবা ইয়াসমিন নামে একজন বহুতল ভবনও নির্মাণ করছেন। জমির ক্রেতারা জানান, জাকিয়া যে ঋণের বিপরীতে ওই জমি ব্যাংকে বন্ধক রেখেছেন তা তারা এত দিন জানতেই পারেননি। সম্প্রতি ব্যাংক মামলা করার পর জেনেছেন।
জমিটি উদ্ধারে জাকিয়া ও পাঁচ ক্রেতার বিরুদ্ধে গত ১ জুলাই আদালতে মামলা করেন সোনালী ব্যাংক পটুয়াখালী শাখার ব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান। তিনি জানান, বিচারক অভিযোগটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের ধারণা, দলিলের সার্টিফায়েড কপি তুলে জমি বিক্রি করেছেন জাকিয়া।
মামলা সূত্রে জানা যায়, জাকিয়া ২০০২ সালের ২১ আগস্ট দিলরুবা ইসলাম হেপীর কাছে ৪ শতাংশ, ২০০৫ সালের ২৩ নভেম্বর হাফেজ মো. বজলুর কাছে ১০ শতাংশ, একই বছরের ১৫ মার্চ নুরুল ইসলাম তালুকদারকে পৃথক দুটি দলিলে ৫ শতাংশ করে ১০ শতাংশ এবং ২০১০ সালের ২৩ আগস্ট আব্দুর রাজ্জাক সিকদারকে ৪ শতাংশ জমি সাবকবলা দলিল দেন।
তাদের মধ্যে নুরুল আলম তালুকদার বলেন, কেনার সময় তারা বরিশালের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে খোঁজ নিয়ে জমির দলিল নির্ভেজাল বলে নিশ্চিত হন। তবে জমিটি আরেক জেলা পটুয়াখালীর সোনালী ব্যাংকে বন্ধক রাখায় তারা জানতে পারেননি। সম্প্রতি ব্যাংক থেকে তাদের কারণ দর্শাতে বলার পর জাকিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জাকিয়া তাদের আশ্বস্ত করেছেন, তিন মাসের মধ্যে সমাধান করে দেবেন।
আরেক ক্রেতা নুরুল আলম তালুকদারের ছেলে রেজাউল কবীর বলেন, পুরো জমিটা ছিল নিচু। কোমর সমান পানি থাকত। তারা ভরাট করে বসত উপযোগী করেছেন। আর হাফেজ মো. বজলু সমকালকে বলেন, তিনি ২০০৫ সালে জমি কিনেছেন। মাসখানেক আগে জানতে পারেন ওই জমির বিপরীতে ব্যাংক ঋণ রয়েছে। কেনার সময় ঠিকমতো খোঁজ না নেওয়ায় এমনটা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা মাইদুল ইসলাম জানান, মহাসড়কের পাশে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ওই জমির মূল্য প্রতি শতাংশ কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা পটুয়াখালী সোনালী ব্যাংক থেকে জানা যায়, সুদাসলে জাকিয়ার কাছে তাদের প্রাপ্তি ৮৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। অর্থঋণ আদালতে মামলাসহ সব ধরনের চেষ্টা করেও তারা ওই ঋথ আদায়ে ব্যর্থ হয়। এর পর ২০২২ সালের ২২ জানুয়ারি সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় সুদের নানা খাত মওকুফ করে জাকিয়াকে ৩ কোটি ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়। ৬ বছরে ৭২ কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের সেই সুযোগও জাকিয়া নেননি। এর পর ব্যাংকের মামলায় গত ২০ জুলাই পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করলে ৬ দিন কারাগারে থেকে জামিন পান।
জমি বিক্রির এত বছর পর ব্যাংকের তৎপরতা নিয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংক পটুয়াখালী জোনের উপমহাব্যবস্থাপক সেলিম হায়দার সমকালকে বলেন, জাকিয়া ও তাঁর প্রয়াত স্বামী সিরাজুল নানা অপতৎপরতার মাধ্যমে ব্যাংকের করা মামলায় দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করেন। আদালতে তাদের দেওয়া সব নথিতে দেখানো হয় জমিটি জাকিয়ার দখলে রয়েছে। এ কারণে আদালত নিলাম না দেওয়ায় ব্যাংকও জমি দখলে যায়নি। গত ২০ জুলাই জাকিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর তারা জানতে পারেন বন্ধকি জমি বহু বছর আগেই বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জাকিয়ার সঞ্চয়পত্রের ৪৫ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জাকিয়ার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
- বিষয় :
- জমি দখল
- আওয়ামী লীগ
- আওয়ামী লীগ নেতা
- বরিশাল