ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু 

মামলার আগেই অভিযান, গোয়েন্দা পুলিশের তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন

মামলার আগেই অভিযান, গোয়েন্দা পুলিশের তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন

ফয়সাল খান ওরফে শুভ। ছবি-সংগৃহীত

ফুলবাড়িয়া (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি 

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:১৯

ময়মনসিংহের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘিরে রহস্য তৈরি হয়েছে। ডিবি পুলিশের অভিযানের পর বাসার সামনে থেকে রক্তাক্ত ও অচেতন অবস্থায় উদ্ধারের পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। পরিবারের অভিযোগ, পুলিশের সঙ্গে থাকা লোকজন তাঁকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করেছে। আবার মামলা নথিভুক্ত হওয়ার আগেই অভিযান পরিচালনা করায় ডিবি পুলিশের তৎপরতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। 

নিহত ফয়সাল খান শুভ (৩০) ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সরিষা কাশিপুর এলাকার সেলিম খানের ছেলে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করে তিনি নগরের কেওয়াটখালী পাওয়ার হাউস রোডে বড় বোনের বাসায় থেকে চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলেন। 

জানা গেছে, ফয়সাল ও তাঁর চার স্বজনের বিরুদ্ধে ইশ্বরগঞ্জ থানায় পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা হয় ১০ নভেম্বর রাত ১২টা ৫ মিনিটে। কিন্তু তার আগেই ওইদিন রাত ৯টা ৩৮ মিনিটে ফয়সালের বোনের বাসায় অভিযানে যায় ডিবি পুলিশ। 

নিহতের পরিবারের অভিযোগ, ফয়সালের সঙ্গে একই গ্রামের সুলতান উদ্দিনের মেয়ের চার বছর ধরে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সম্প্রতি ওই মেয়ের সরকারি চাকরি হয় এবং ফয়সালের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। গত শুক্রবার ওই মেয়ের তাঁর ব্যাচমেটের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বিষয়টি ফয়সাল জানতে পেরে ওই ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু ছবি-ভিডিও পাঠান। এ ঘটনায় ওই মেয়ের বাবা সুলতান আহমেদ গত ১০ নভেম্বর ঈশ্বরগঞ্জ থানায় ফয়সালসহ চারজনের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি আইনে অভিযোগ দেন। একই অভিযোগ তিনি ডিবি পুলিশকেও দিয়েছিলেন। 

নিহত ফয়সালের ভগ্নিপতি মোহসিন জানান, মেয়ের বাবার অভিযোগে গত ১০ নভেম্বর রাত সাড়ে ৯টার দিকে ডিবি পুলিশ তাঁর বাসায় যায়। তাদের সঙ্গে ওই মেয়ের বাবা ও ভাই ছিল। পুলিশ বাসায় ফয়সালকে খোঁজাখুজি করলেও ওই মেয়ের বাবা ও দুই ভাই বাসার ছাদে গিয়ে ফয়সালকে পেয়ে ধাক্কা দিয়ে বাসার নিচে ফেলে দেন। পরে ডিবি পুলিশসহ তাঁরা সবাই চলে যান। ডিবির ১৮ মিনিটের অভিযান শেষে রাত ৯টা ৫৬ মিনিটে পাঁচতলা ভবনের নিচ থেকে ফয়সালকে রক্তাক্ত ও অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করেন স্বজনরা। গত শুক্রবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকার একটি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। 

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ১০ নভেম্বর রাত ৯টা ৩৮ মিনিটে বাসার নিচের কলাপসিবল গেট খুলে দিচ্ছেন ফয়সালের ভগ্নিপতি মোহসিনুল হক। এ সময় ডিবি পুলিশ লেখা পোশাক পরা চারজন এবং সিভিল পোশাকে চারজন সিঁড়ি বেয়ে দোতলার দিকে যান। সিভিল পোশাকের একজনের হাতে ওয়াকিটকি দেখে পুলিশ সদস্য বলে ধারণা করা হয়। বাকি তিনজনের মধ্যে শেষের দিকে থাকা দু’জনের একজনের মুখে মাস্ক ও একজনের মাথায় ক্যাপ পরা দেখা যায়। ডিবি নিশ্চিত করেছে, অভিযানে মোট ছয়জন পুলিশ সদস্য ছিলেন। অন্য দু’জনের একজন ওই তরুণীর খালাতো ভাই আসিফ সাইফুল্লাহ বলে জানিয়েছেন ফয়সালের স্বজনরা। অন্যজনের পরিচয় মেলেনি। 
ডিবির সঙ্গে থাকা আসিফ ও মুখে মাস্ক পরা ব্যক্তি সরাসরি বাসার ছাদে চলে যান বলে জানান মোহসিনুল হক। তিনি বলেন, বাসার বাইরে ডিবি পুলিশ দেখে দোতলার আরেকটি দরজা দিয়ে ফয়সাল পাঁচতলায় এবং আমার স্ত্রী তৃতীয় তলায় চলে যান। বাসায় তল্লাশি শেষে তারা তৃতীয় তলায় ওঠে। তখন ছাদের দিক থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামেন আসিফ ও সঙ্গে থাকা অন্যজন। তাঁরা বলতে থাকেন ওপরে ফয়সাল নেই। পরে তারা সবাই চলে যায়। 

এ ঘটনায় ১২ নভেম্বর কোতোয়ালি মডেল থানায় ফয়সালের বাবা সেলিম খান বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে বাসায় ঢুকে হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর করে ফয়সালকে বাসার নিচে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ করা হয়। এতে তরুণীর বাবাসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করা হয়। এ ঘটনায় রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা যায়নি বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি শফিকুল ইসলাম খান। 

ভগ্নিপতি মোহসিনুল হকের অভিযোগ, পুলিশ প্রথমে আমাদের মামলা নিতে চায়নি, এখনো আসামি গ্রেপ্তার করতে পারছে না। একজনকে গ্রেপ্তার করলেও কীভাবে ঘটনাটি ঘটেছে, তা বেরিয়ে আসত। আমরা চাচ্ছি ঘটনার সঠিক তথ্য বের হোক। যারা জড়িত, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হোক।’

ময়মনসিংহ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এইচ এম খালেকুজ্জামান বলেন, আইন অনুযায়ী পুলিশ বাদীপক্ষের লোকজন নিয়ে অভিযানে যেতে পারে না। কোনো বাসায় তল্লাশি চালাতে হলে এলাকার গণমান্য ব্যক্তিকে সঙ্গে নিতে পারে। যেহেতু পুলিশের সঙ্গে বাইরের লোক প্রবেশ করেছে, তাঁদের দায়িত্বও পুলিশের। 

ময়মনসিংহ ডিবির ওসি সহিদুল ইসলাম বলেন, লিখিত অভিযোগ পেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শে অভিযান চালানো হয়। সিসিটিভি ফুটেজ দেখালে তিনি ছয়জনকে পুলিশ সদস্য হিসেবে নিশ্চিত করেন। বাকি দু’জন সোর্স হিসেবে কাজ করেছে বলে জানান। বাইরের লোক নিয়ে অভিযানে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আসামি দেখিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের নেওয়া হয়েছিল।’ তাঁরা কেন ছাদে গেল প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেই জন্যই তো মামলা হয়েছে।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×