তীব্র ভাঙনের মধ্যে পদ্মায় বালু উত্তোলনের মচ্ছব
চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাণীনগরে পদ্মা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে বাঁধের অংশ সমকাল
এ কে এস রোকন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:২৩
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলায় পদ্মা নদীতে তীব্র ভাঙনের মধ্যেও পাড় ঘেঁষে চলছে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের মচ্ছব। এতে হুমকিতে রয়েছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নদী রক্ষা বাঁধ। বালু উত্তোলনের কারণে ইতোমধ্যে বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কয়েক হাজার বিঘা ফসলি জমি, বসতবাড়ি, পার্ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও এখন বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বালু উত্তোলন বন্ধের জন্য দু’দফা দাবিতে আন্দোলন করেও প্রশাসনের টনক নড়েনি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ও শিবগঞ্জের প্রায় ছয় কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। শাহজাহানপুর ইউনিয়নের পদ্মাপাড়ের বাসিন্দা আফসারুল আলমের ভাষ্য, নদীর ধারে বালু উত্তোলনের কারণে বাঁধের নিচে গর্ত তৈরি হচ্ছে। সরে যাচ্ছে ব্লক। বাঁধ ভেঙে বিলীন হয়েছে ঘরবাড়ি। যদিও বালু উত্তোলন বন্ধ রেখে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে দাবি স্থানীয় প্রশাসনের।
সরেজমিন দেখা গেছে, ভরা পদ্মার পাড় ঘেঁষে ভারতীয় সীমান্তবর্তী রাণীনগর-দুর্লভপুর এলাকায় তোলা হচ্ছে বালু। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নিয়ম-নীতি ও বালুমহাল আইন অমান্য করে বালু তোলায় বিলীন হয়েছে হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি ও বসতবাড়ি। নদীতে চলে গেছে সদর উপজেলার আলাতুলী ইউনিয়নের প্রায় অর্ধেক এলাকা। ঘরছাড়া হয়েছেন হাজারো মানুষ। পদ্মার বাঁ তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের কিছু অংশ ইতোমধ্যেই ভেঙে গেছে।
আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধের দাবিতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডে (পাউবো) অভিযোগ দিলেও সুরাহা মেলেনি বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। উল্টো বাধা দিতে গিয়ে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখান বালু উত্তোলনকারীরা। বাঁধ রক্ষা ও মোহনা পার্কসংলগ্ন স্থানে বালু উত্তোলন বন্ধের দাবিতে গত ১৬ অক্টোবর বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ও স্মারকলিপি দেন সদর উপজেলার চরাঞ্চলের চর-আলাতুলি, দেবিনগর ও শাহজাহানপুর ইউনিয়নের মানুষ। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে এ কর্মসূচি পালন করা হয়।
তিন ইউনিয়নের বাসিন্দাদের দাবি, ভাঙন ঠেকাতে ভবিষ্যতে বালুমহালের ইজারা বাতিল, সাত দিনের মধ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ ও এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া, যারা অন্যায় কাজে বাধা দিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন– তাদের হয়রানি বন্ধ করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি হুমকিদাতাদের তদন্ত সাপেক্ষ শাস্তি নিশ্চিত করা এবং ভুক্তভোগীদের সর্বত্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এর পরও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
শাহজাহানপুর ইউনিয়নের পদ্মাপাড়ের বাসিন্দা কাউসার আলী বলেন, নদীর ধারে ২০২১ সালে সরকারিভাবে নির্মিত মোহনা পার্কও রয়েছে ভাঙনের কবলে পড়ার শঙ্কায়। বালু উত্তোলনের কারণে ভাঙনের আশঙ্কায় তারা আতঙ্কিত হলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। রাণীনগর গ্রামের শফিকুল ইসলামের ভাষ্য, গত ৯ সেপ্টেম্বর স্থানীয়দের পক্ষে যৌথ বাহিনীকে বালু উত্তোলনে জড়িত ছয়জনের পরিচয় উল্লেখ করে অভিযোগ দেওয়া হয়। এর পরও বালু উত্তোলন চলছেই।
এক স্থানে ইজারা নিয়ে অন্য জায়গায় বালু উত্তোলন করছে– অভিযোগ করে একই গ্রামের আব্দুর রাকিব বলেন, আলাতুলি ইউনিয়নের প্রায় অর্ধেক এলাকা ইতোমধ্যেই বিলীন হয়েছে। সব হারিয়ে কৃষকরা নিঃস্ব। অথচ এর কোনো প্রতিকার নেই। আর বৃদ্ধ নবীর আলীর প্রশ্ন, ৩৫০ কোটি টাকার বাঁধ বাঁচানো জরুরি, নাকি সরকারের সোয়া ৫ কোটি টাকার আয় জরুরি?
বালু উত্তোলনের সঙ্গে যুক্ত মো. বকুল হোসেন বলেন, প্রায় ১৬ বছর আগে জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্টরা হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের মাধ্যমে রানীনগর এলাকা বাছাই করে দীর্ঘদিন ইজারা দিয়ে আসছে। এর আলোকে, দাদু ভাই কনস্ট্রাকশনের পক্ষে তিনি বাংলা ১৪৩১ সালে ১ বছরের জন্য ৫ কোটি ২০ লাখ টাকায় বালু উত্তোলনের অনুমোদন নিয়েছেন। সে অনুযায়ী সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করে ঢাল প্রসেস পদ্ধতিতে বালু উত্তোলন করছেন বলে দাবি তাঁর।
বালু উত্তোলনের কারণে নদীভাঙন দেখা দেওয়ার বিষয়ে বকুল হোসেন বলেন, জনগণের সম্মতিতে সরকারের দেখানো লাল পতাকা বসানো স্থানে বাঁধের বিপরীতে ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষে বালু উত্তোলন হচ্ছে। তাই ভাঙনের বিষয়টি তাদের বিবেচ্য নয়।
সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, এক মাস আগে বালুমহাল ইজারা বাতিল ও অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করে ফসলি জমি ও বসতভিটা রক্ষার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার ছয় দফা দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। এর পরও বালু উত্তোলন অব্যাহত আছে, যা দুঃখজনক।
এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাছমিনা খাতুন বলেন, স্থানীয়দের অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। জনস্বার্থ বিঘ্ন করে এবং ফসলি জমি, বাঁধ এবং পার্ক হুমকিতে থাকলে বালু উত্তোলন বন্ধের আশ্বাস দেন তিনি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম আহসান হাবিব বালু উত্তেলনের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, বাঁধে কিছুটা ভাঙন দেখা দিয়েছে। বাজেট পেলে ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
- বিষয় :
- নদী