ঢাকা শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪

হাটবাজারের রাজস্ব হরিলুট

হাটবাজারের রাজস্ব হরিলুট

.

 পঙ্কজ দে, সুনামগঞ্জ

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৩৫

বিগত সরকারের শাসনামলে হাওর-বাঁওড়ের জেলা সুনামগঞ্জে রাজস্ব আদায়ের সব খাতেই ছিল কালো থাবা। কোথাও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে, আবার কোথাও রাজস্ব আদায়ে অসহায় ছিল প্রশাসন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাবেক এমপি ও দলীয় নেতাকর্মীর চাপে হাটবাজার থেকে পুরোপুরি রাজস্ব বঞ্চিত হয় রাষ্ট্র। জেলার ১৯২টি বাজারের ৬৯টি গত মৌসুমে ইজারা দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
প্রশাসনের রাজস্ব-সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মচারী জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জের বড় বাজারগুলোর মধ্যে মধ্যনগর বাজার গেল বৈশাখ মাসে ইজারা হয়নি। সরকারদলীয়রা যোগসাজশে ইজারামূল্য কমিয়ে দেওয়ায় উপজেলা প্রশাসন ইজারাই দিতে পারেনি। অথচ আগের বছর ১৪৩০ বাংলা সনে সাড়ে ৯০ লাখ টাকা রাজস্ব পেয়েছিল সরকার। কিন্তু গত বৈশাখে ৩৫ লাখ টাকার ওপরে দর পাওয়া যায়নি। মধ্যনগর উপজেলার বংশীকুণ্ডা বাজারসহ আরও অনেক বাজারের ক্ষেত্রে ছিল একই অবস্থা।
গেল মৌসুমে ইজারা না দিয়ে মধ্যনগর বাজার থেকে খাস কালেকশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলমগীর খসরুসহ দলের স্থানীয় নেতাদের। তারা বাঁশমহাল, ধান, কাঠ, জাল, ডিম, ফল, কাপড়, টিন মহালসহ বিভিন্ন মহাল সারা বছরের জন্য সাব-ইজারা দিয়ে অনেকের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। তবে তারা সবাইকে জানান, এই টাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে রাজস্ব খাতে জমা দিয়েছেন। 
মধ্যনগর উপজেলার সাবেক ইউএনও বর্তমানে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অতীশ দর্শী চাকমা সমকালকে বলেন, তৎকালীন সরকারদলীয়দের চাপে অনেক হাটবাজার ইজারা দেওয়া যায়নি। তিনি আরও জানান, তাঁর কাছে মধ্যনগর বাজারের খাস কালেকশনের কোনো টাকা দেওয়া হয়নি।
মধ্যনগর ধান আড়তদার সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোপেশ সরকার বলেন, ধানমহালের জন্য তারা ১৮ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। অন্য মহাল থেকেও টাকা ওঠানো হয়েছিল।
গত ৫ আগস্টের পর আলমগীর খসরু এলাকা ছেড়েছেন। তাদের দলের অন্যরাও এলাকায় নেই। গত ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত খাস কালেকশন করেছেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা। ওই পর্যন্ত খাস কালেকশন হয়েছিল সাড়ে ৭ লাখ টাকা। সম্প্রতি স্থানীয় প্রশাসন বাজারের উন্মুক্ত দর আহ্বান করলে ব্যবসায়ী তাজুল ইসলাম, বিপ্লব তালুকদারসহ কয়েকজন খাস কালেকশনের দায়িত্ব নিয়েছেন। তারা পৃথকভাবে দুই দফায় ৩ লাখ ৭২ হাজার ৫০০ টাকা দর দিয়েছেন। তাতে বৈশাখ থেকে কার্তিক পর্যন্ত সাত মাসে সরকার রাজস্ব পেয়েছে মাত্র সোয়া ১১ লাখ টাকা। এখান থেকে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে ৮০ লাখ টাকা।
তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট বাজারেরও একই অবস্থা। এই বাজার ১৪২৯ বঙ্গাব্দে ৬০ লাখ টাকায় ইজারা হয়েছিল। কিন্তু পরের বছর ১৪৩০ সালে উপজেলা পরিষদ বাজারটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় ইজারা দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেও অদৃশ্য কারণে ইজারা হয়নি।
স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি জানান, এলাকার আওয়ামী লীগের তৎকালীন এমপি রঞ্জিত সরকারের চাওয়া ছিল ইজারা না দিয়ে খাস কালেকশন দেওয়া। এই কারণে খাস কালেকশন উঠানোর জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা আপ্তাব উদ্দিন ও উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়ন 
পরিষদ চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা মাসুক মিয়াসহ অন্যদের। নামমাত্র খাস কালেকশন জমা দিয়ে ১৪৩০ বাংলা সনের বৈশাখ থেকে ২১ শ্রাবণ (৫ আগস্ট) পর্যন্ত বাজারের রাজস্ব লুটেপুটে খেয়েছেন তারা। 
সরকার পতনের পর বাদাঘাট বাজারে খাস কালেকশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আজিজুল হকসহ কিছু বিএনপি নেতাকে। এই বাজারে কী পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়েছে জানতে চাইলে আজিজুল বলেন, আমরা যা প্রতিদিন সংগ্রহ করি তা তহশিলদার নিয়ে যান। এ বিষয়ে তহশিলদার রাজর্ষী রায় বলেন, এটা আমি বলতে পারব না, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসের করনিক আব্দুর রউফের কাছে খাস কালেকশনের টাকা জমা দেওয়া হয়। রউফ বলেন, এটা জানাতে এক দিন সময় দেওয়া লাগবে। কিন্তু পাঁচ মিনিট পরে তাঁর হয়ে তাহিরপুর উপজেলা বিএনপির দায়িত্বশীল এক নেতা ও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অনুরোধ জানান এ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। সংশ্লিষ্টরা জানান, এভাবেই রাজনীতিবিদ ও প্রশাসন ঘিরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।
তাহিরপুরের আরেক বিএনপি নেতা জানালেন, উন্মুক্ত প্রক্রিয়ায় নিয়ম অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করে ইজারা দিলে বাদাঘাট বাজার থেকে বছরে কোটি টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হাসেম জানান, মামলার কারণে বাদাঘাট বাজার ইজারা দেওয়া যায়নি।
ধর্মপাশা ইউএনও মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীন বলেন, আমাকে মধ্যনগরের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়ার পর আমি আইনানুগ প্রক্রিয়ায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে মধ্যনগর বাজারে খাস কালেকশনের জন্য ইজারাদার নিয়োগ করেছি। ইজারা মৌসুমে আইন অনুযায়ী ইজারা দেওয়া হবে। বংশীকুণ্ডা বাজারটিও আগামী সপ্তাহে উন্মুক্ত প্রক্রিয়ায় খাস কালেকশনের জন্য দেওয়া হবে।
সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অতিরিক্ত পিপি শেরেনুর আলী বলেন, বিগত সময়ে প্রভাবশালীদের চাপে রাষ্ট্র এখানকার হাটবাজার থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে। এখন খাস কালেকশনের নামে শুধু হাতবদল করলে একই অবস্থা তৈরি হবে। যে বাজারগুলো ইজারা হয়নি, তার সবই উন্মুক্ত প্রক্রিয়ায় খাস কালেকশনের জন্য দিতে হবে। সুনামগঞ্জের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, তিন বছরের ইজারামূল্যের গড় হিসাব করে যে দর হয়, এর নিচে কেউ হাটবাজারের ইজারা দর দিলে কর্তৃপক্ষকে বেকায়দায় পড়তে হয়। ফেব্রুয়ারি-মার্চে নতুন ইজারা মৌসুম এলেই আসল চিত্র বোঝা যাবে।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×