ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রধান শিক্ষকের ভুয়া ভাউচারের হিসাব মেলাতে হিমশিম

বরিশালের হালিমা খাতুন বালিকা বিদ্যালয়

প্রধান শিক্ষকের ভুয়া ভাউচারের হিসাব মেলাতে হিমশিম

প্রতীকী ছবি

 সুমন চৌধুরী, বরিশাল

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৪৭

চলতি বছরের পহেলা বৈশাখ ছিল ঈদুল ফিতরের তৃতীয় দিন। রমজান, ঈদ ও নববর্ষ মিলিয়ে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তখন ছিল দীর্ঘ ছুটি। তবে পহেলা বৈশাখে বরিশাল নগরের হালিমা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ‘অভিভাবক সমাবেশের’ জন্য ২৮ হাজার টাকার বিরিয়ানি কেনেন প্রধান শিক্ষক এস এম ফখরুজ্জামান! তিন দিন পর ১৭ এপ্রিল একই কারণে দেখানো হয় ২০ হাজার টাকার বিরিয়ানির ভাউচার। তবে সব আয়োজনই ছিল কাগুজে। প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের চলমান তদন্তে এমন গায়েবি অনুষ্ঠান ও কেনাকাটার তথ্য মিলেছে। শুধু বিরিয়ানি নয়, ভৌতিক কেনাকাটার ভাউচার দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে এ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। 

নগরীর গোঁড়াচাঁদ দাস সড়কের হালিমা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় বরিশালের সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। তিন সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর এ বিদ্যালয়ে বার্ষিক আয় প্রায় ৩ কোটি টাকা। গত কয়েক বছরে কোচিং বাণিজ্য নিয়ে শিক্ষকদের দলাদলি, এর জেরে ছাত্রীদের দিয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনা, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটি আলোচিত-সমালোচিত। অভিযোগ, এসবের হোতা প্রধান শিক্ষক এস এম ফখরুজ্জামান। এ নিয়ে সমকালে একাধিক প্রতিবেদন হয়েছে। 

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছেন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার মো. আরিফুজ্জামান। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় প্রধান শিক্ষকের কাছে বিদ্যালয়ের গত ১০ বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব চাওয়া হয়। তাঁর দেওয়া ভাউচার অনুযায়ী, সহকারী কমিশনার আরিফুজ্জামান গত সপ্তাহে ১২টি দোকানে যান। সেসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা জানান, ভাউচারের তারিখে তারা ওই বিদ্যালয়ে কোনো পণ্য বিক্রি করেননি। পূর্ব পরিচয়সূত্রে প্রধান শিক্ষক তাদের কাছ থেকে সাদা ক্যাশমেমো নিয়ে ভুয়া ভাউচার করেছেন।  
গতকাল রোববার সমকাল প্রতিনিধি বিদ্যালয় সংলগ্ন চারটি প্রতিষ্ঠানে গিয়েও একই তথ্য পান। মুন টেইলার্সের একটি ভাউচারে বিদ্যালয়টির ব্যান্ড বাদক দলের জন্য পোশাক তৈরি ও জুতা ক্রয়ে ৯১ হাজার টাকা ব্যয়ের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের মালিক মোস্তফা সরদার জানান, তিনি এমন কোনো পোশাক তৈরি করেননি। আর তাঁর দোকানে জুতা বিক্রি হয় না। প্রধান শিক্ষক সাদা মেমো চেয়ে নিয়েছিলেন। 
মুসলিম সুইটসের মালিক রিপন বলেন, পহেলা বৈশাখে বিরিয়ানি বিক্রির একটি ভাউচার নিয়ে একজন ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর দোকানে এসেছিলেন। তবে তাঁর দোকান তো মিষ্টির। কোনো দিন বিরিয়ানি বিক্রি করেননি। এমনকি ভাউচারটিতে তাঁর দোকানের নাম থাকলেও এটি তাদের নয়। 
নবাব বিরিয়ানি ঘরের মালিক ইমরান হোসেন বলেন, ২০ হাজার টাকার বিরিয়ানির ভাউচারের ক্রমিক নং ২১৩। ওই ক্রমিক নম্বরের ভাউচারটি তিনি ব্যবহার করেছেন ৯ সেপ্টেম্বর। তিনি বিষয়টি ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়েছেন। 

এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার আরিফুজ্জামান বলেন, ১০ বছরের হিসাব চেয়েছিলাম। এক বছরের হিসাব মেলাতেই হিমশিম খাচ্ছি। বিদ্যালয় পুকুরের চারপাশে ওয়াকওয়ে ও উদ্যান নির্মাণে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু বিধি না মেনে কাজটি করা হয়েছে দরপত্র আহ্বান ছাড়া। 
এদিকে তদন্ত কর্মকর্তারা গতকাল ফের বিদ্যালয়টিতে যান। সেখানে ক্রয় কমিটির চার শিক্ষকের মধ্যে তিনজন লিখিতভাবে তাদের জানান, সব ভাউচার যাচাই-বাছাই করে সই করার সুযোগ তাদের হয়নি। কমিটির সদস্য সহকারী শিক্ষক শফিকুল ইসলাম এ তথ্য সমকালকে নিশ্চিত করেছেন। 

বিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ও পিএসসি সদস্য ফয়েজ আহমেদ প্রধান শিক্ষকের ভগ্নিপতি। এ জন্য তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না। এখন মহানগর বিএনপির এক শীর্ষ নেতাকে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে নতুন করে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।  
এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক ফখরুজ্জামানকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তদন্তাধীন বিষয়ে কথা বলবেন না বলে জানান। 
শিক্ষককে মারধরের প্রতিবাদে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মানববন্ধন বিদ্যালয়ে ঢুকে এক শিক্ষককে বহিরাগতদের মারধরের প্রতিবাদে প্রধান শিক্ষকের বিচার চেয়ে রোববার স্কুল সংলগ্ন সড়কে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। পরে সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার দুপুরে  প্রধান শিক্ষক ফখরুজ্জামানের পক্ষে একদল বহিরাগত যুবক বিদ্যালয়ে ঢুকে সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মো. মহিউদ্দিনকে মারধর করে। 
সেখান থেকে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক তারেক সোলায়মানকে বিক্ষুব্ধরা আটক করেন। পরে সেনাবাহিনীর কাছে মুচলেকা দিয়ে তিনি ছাড়া পান। 
এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক দাবি করেন, বরখাস্ত শিক্ষক মহিউদ্দিনকে বৃহস্পতিবার বিদ্যালয়ে ঢুকে উস্কানিমূলক লিফলেট বিতরণ করায় অভিভাবকরা মারধর করেছেন।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×