ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আংগারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

ভয় কখন ছাদ ধসে যায়

ভয় কখন ছাদ ধসে যায়

এভাবে ঝুঁকি নিয়েই বিদ্যালয়ে ক্লাস করতে হয় ছাত্রছাত্রীদের। ছবি: সমকাল

সোহাগ খান সুজন, শরীয়তপুর

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৪ | ০২:৪২

ভাঙা ছাদ থেকে প্রায়ই খসে পড়ে পলেস্তারা। কোথাও কোথাও বেরিয়ে আছে রড। বৃষ্টি এলেই ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে। ছাদের পাশাপাশি ফাটল ধরেছে দেয়াল, পিলার ও বিমেও। সামান্য খোঁচা দিলেই পলেস্তারা ঝুরঝুরিয়ে পড়তে থাকে।

এমন চিত্র শরীয়তপুর সদরের আংগারিয়া এলাকায় অবস্থিত ৪৯ নম্বর আংগারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোতলা ভবনে। এর মধ্যেই ভবনধসের ঝুঁকি নিয়ে শিশুদের পাঠদান করেন শিক্ষকরা। সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে আতঙ্কে থাকতে হয় মা-বাবাকেও।

ওই বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে আংগারিয়া এলাকার মাইনুদ্দিন মিয়া। তার মা রেহানা আক্তার সোমবার বলেন, বিদ্যালয় ভবনের ওপরে ফাটল ধরেছে। রডও দেখা যায়। বাচ্চাকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়ে বাড়িতে থাকতে হয় তাঁকে। তিনি বলেন, দুর্ঘটনা ঘটলে যে ওপর থেকে নিচে নামবে দ্রুত, এমন অবস্থাও নেই। শিশুদের কথা চিন্তা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে নতুন ভবন নির্মাণে সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি। 

এদিন বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, খুদে শিক্ষার্থীরা দোতলায় প্রথম শ্রেণির ক্লাস করছে। তাদের মাথার ওপর কক্ষের বিমের পলেস্তারা খসে রড বেরিয়ে আছে। এ ছাড়া পাশের আরেকটি কক্ষের বিমে রয়েছে বড় ধরনের ফাটল। বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে কক্ষের ওপরের তলাগুলোতে শ্যাওলা জমেছে। এসব কক্ষ স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। ছাদ থেকে বইয়ের ওপর ঝুরঝুরিয়ে পড়ছে বালু-সিমেন্টের কণা। 

প্রথম শ্রেণির ছাত্রী তনুশ্রী বিশ্বাস পিউ বলে, ‘আমাদের স্কুলের ওপর দিক দিয়ে ভাঙা। বর্ষাকালে জল পড়ে, বালু পড়ে। আমাদের ক্লাস করতে ভীষণ ভয় করে। আমরা চাই, নতুন স্কুল তৈরি করা হোক।’

একই শ্রেণির তীর্থ নামের আরেকজন জানায়, তাদের অনেক ভয় করে। কখন যে তাদের ওপর ভেঙে পড়ে! এভাবে ক্লাস করতে একদম ভালো লাগে না। নতুন একটি বিদ্যালয় চায় সে। 

চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী জেরিন আক্তার বলে, ‘যখন ক্লাস করি, তখন অনেক সময় ওপর থেকে বালু আর ইটের কণা পড়ে। গতকালও (রোববার) আমার মাথায় খোয়া পড়েছে। এভাবে ক্লাস করা খুবই কষ্টের।’ সরকার যেন দ্রুত তাদের বিদ্যালয়ের জন্য নতুন ভবন করে দেয়, সেই আকুতি জানায় জেরিন।

জানা যায়, ১৯৩৭ সালে শরীয়তপুর সদর উপজেলার আংগারিয়া এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ৪৯ নম্বর আংগারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। বর্তমানে এখানে পড়ছে ২৩১ জন ছাত্রছাত্রী। তাদের বিপরীতে শিক্ষকসংখ্যা ১০। বিদ্যালয়টির শুরুর দিকে একটি আধাপাকা ভবন ছিল। ১৯৮৯ সালে পাঁচ কক্ষের দ্বিতল ভবনটি তৈরি করে প্রাথমিক শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। সেই ভবনটিই এখন পুরোপুরি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ছাদটিই এখন বড় আতঙ্কের হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্ঘটনার আশঙ্কার কথা বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন শিক্ষকরা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান মেলেনি। 

এসব আতঙ্কের কারণে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পারছেন না বলে জানান সহকারী শিক্ষকরা। তাদের ভাষ্য, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, পাশাপাশি তাদের উপস্থিতিও কমছে।

সহকারী শিক্ষিকা আসমা আকতার বলেন, ‘আমাদের ভবনটি দীর্ঘদিন ধরে নাজুক। আমরা ঠিকমতো ক্লাস নিতে পারছি না।’ এর আগেও ওপর থেকে ছাদ ভেঙে ফ্যান পড়ে গিয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আমরা সবাই আতঙ্কে থাকি। তা ছাড়া বৃষ্টির দিনে পানি পড়তে থাকে। ক্লাস নিতে পারি না। শিশুদের বই-খাতা ভিজে যায়। এ অবস্থা থেকে মুক্তি চান তিনি। 

ইউনূস শেখ নামের আরেক সহকারী শিক্ষক বলেন, শিক্ষার্থীদের আতঙ্ক নিয়ে ক্লাস করতে হয় বলে ওদের পড়ায় মনোযোগ থাকে না। এমনিতে বিদ্যালয়ে পড়ার পরিবেশ ভালো। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কারণে দিন দিন শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের একটি ভবন দরকার। 

এ সমস্যার কথা বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও সুরাহা হয়নি বলে জানান প্রধান শিক্ষক উম্মে কুলসুম। তাঁর ভাষ্য, ‘দোতলা ভবনটি দীর্ঘদিন ধরে নাজুক অবস্থায় পড়ে আছে। অথচ আমাদের এভাবেই শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বিষয়টি বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’ কিন্তু কেন সমাধান হচ্ছে না– এমন প্রশ্নের উত্তর তাঁরও অজানা। উম্মে কুলসুম বলেন, ‘আমার বিনীত অনুরোধ, ছোট সোনামণিদের কথা চিন্তা করে দ্রুত একটি নতুন ভবন তৈরি হোক।’

এদিকে ওই বিদ্যালয়ে ভবনের জন্য বরাদ্দ এসেছিল বলে জানান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নুরুল হক। তাঁর ভাষ্য, কোনো কারণে সেই বরাদ্দ বাতিল হয়ে যায়। কী কারণে তা বাতিল হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখা ও নতুন বরাদ্দে উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস দেন। নুরুল হক আরও বলেন, ‘নতুন ভবন নির্মাণের একটি প্রক্রিয়া রয়েছে। এগুলো একটি ডেটাবেজের অন্তর্ভুক্ত। যখন বরাদ্দ আসে, তখনই আমরা সহযোগিতা করি।’

আরও পড়ুন

×