ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

বাগানজুড়ে শিশুর পাঠশালা

বাগানজুড়ে শিশুর পাঠশালা

কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া গ্রামে গড়াই নদীর কূল ঘেঁষে বিদ্যানিকেতন গড়ে তুলেছেন ৭৪ বছর বয়সী নাসির উদ্দিন সমকাল

 মিজানুর রহমান নয়ন, কুমারখালী (কুষ্টিয়া) 

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:১৯

গড়াই নদীর কূল ঘেঁষে সরু পাকা সড়ক। এরই পাশে দৃষ্টিনন্দন বাগান। গাছের নিচে বিছানো ত্রিপলে রং-তুলি ও কাগজ নিয়ে বসেছে শতাধিক শিশু। কেউ কেউ আঁকছে গ্রামীণ জীবনের চিত্র। বাগানে আছে দোলনা, পাঠাগার, জাদুঘর, শরীরচর্চার সামগ্রী ও বিলুপ্তপ্রায় নানা প্রজাতির গাছ। কোনো কোনো শিশু খেলা করছে, কেউবা বই পড়ছে।
কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া গ্রামে নাসির উদ্দিনের বাড়ির বাগানে প্রতি শুক্রবারই সকালের দৃশ্য এমন। যেন শিশুদের মিলন মেলা। উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে এই গ্রাম। এক পাশে গড়াই এবং অপর পাশে পদ্মা নদী। প্রাচীন নিদর্শন ও গ্রামীণ জীবনের নানা উপকরণ সংরক্ষণ করেন ৭৪ বছর বয়সী নাসির উদ্দিন। শুক্রবার এলেই শিশুনিকেতনে পরিণত হয় তাঁর বাগান। তিনি বলেন, শিশুদের জন্য গড়তে চান স্বর্গরাজ্য। ৩৩ শতাংশ জমির ওপর বাগানসহ তাঁর বসতভিটা। রয়েছে বিনোদন ও শরীরচর্চা কেন্দ্র, পাঠাগার, জাদুঘর, সংবাদ সংগ্রহশালা। আশপাশের এলাকা থেকে বিভিন্ন বয়সী শিশু আসে। তারা বই পড়ে, খেলা করে, বিলুপ্তপ্রায় হরেক প্রজাতির গাছের সঙ্গে পরিচিত হয়। জাদুঘরে সংরক্ষিত ঐতিহ্যবাহী তৈজসপত্র দেখে চিরায়ত গ্রামীণ জীবনের স্পর্শ অনুভব করে। তিনি বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে ছেলেমেয়েদের তাঁর বাগানে আসতে বলেন। বই পড়তে উৎসাহিত করেন। পাঠাগার গড়ে তুলতে স্থানীয় শিক্ষিত মানুষকে উৎসাহ দেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি। ২০০৫ সালে পেনশনের টাকায় শিশুদের বিনোদন ও মেধা বিকাশের জন্য বাড়ির আঙিনায় বাবা-মায়ের নামে ‘কুলছুম নেছা- জালাল গান্ধী শিশুপার্ক’ গড়ে তোলেন। ৫০ বছর ধরে বিলুপ্তপ্রায় গাছ বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। বাগানে প্রায় ২০০ প্রজাতির ফলদ, বনজ, ঔষধি ও শোভাবর্ধনকারী গাছ আছে। প্রতিটি গাছে কাগজের ওপর লেমিনেটিং করে নাম লেখা আছে, যাতে শিশুরা পড়ে চিনতে পারে। বাগানে আছে বনকাঁঠাল, লাটা, ঢেপড়, ফলশাহী, মিষ্টি আমলকী, করমচা, জামরুল, হরগৌড়ি ইত্যাদি গাছ। নাসির উদ্দিন বলেন, বিলুপ্তপ্রায় ফলদ, বনজ, ঔষধি ও শোভাবর্ধনের গাছ সংরক্ষণে তিনি চেষ্টা করছেন। বাগানে বেশির ভাগই ঔষধি গাছ। যার যখন খুশি প্রয়োজন মতো নিয়ে যাচ্ছেন।
বাগানের মাঝখানে একটি ছোট্ট আধাপাকা ঘরে মায়ের নামে একটি পাঠাগার, জাদুঘর ও সংবাদ সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন তিনি। পাঠাগারে শিশুদের মেধা বিকাশ, শরীর গঠনবিষয়ক বইসহ পাঁচ শতাধিক পুস্তক আছে। জাদুঘরে সেন ও পাল বংশ এবং ব্রিটিশ আমলের ইট, থালা, পানের বাটা, বিলুপ্তপ্রায় হারিকেন, ঢেঁকি, পালকি, ডাক টিকিট, হুক্কা, নাঙল, মাথাল, ঢালসহ শতাধিক উপকরণ আছে। সংবাদ সংগ্রহশালায় শিশুদের স্বাস্থ্যবিধি ও নানা বয়সী শিশুদের লেখা এবং দেশ-বিদেশের আবিষ্কারক বিষয়ক পত্রিকা ও পত্রিকার কাটিং রাখা হয়েছে।
নাসির উদ্দিন জানান, তাঁর নানি ও মায়ের ব্যবৃহত পানের বাটা, পান ছেঁচনি ও চিনামাটির পুতুল দেখে তিনি জাদুঘর স্থাপনে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক উপকরণ সংরক্ষণ করেছেন। এগুলো থেকে শিশুরা প্রাচীনকাল সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে।
কয়া গ্রামের গৃহিণী প্রিয়াংকা দত্ত বলেন, পহেলা বৈশাখ, নবান্ন উৎসবসহ নানা পার্বণে নাসির স্যার শিশু-কিশোরদের নিয়ে আনন্দ আয়োজন করেন। এ ছাড়া শহীদ দিবস, বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন দিবস পালন করেন। গাছে ফল পাকলে শিশুদের নিয়ে উৎসব হয় বাগানে। আনন্দ করে ফল খায় শিশুরা। 
কয়া ইসলামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী ইরিনা জানায়, নাসির স্যার বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও তাঁর আচরণ শিশুর মতো। গাছ, পাখি ও বই যাদের ভালো লাগে, তারা ছুটে আসে বাগানে। অনেক শেখার আছে সেখানে।
নাসির উদ্দিনের মতো আলোকিত মানুষ দেশের কল্যাণে অনেক অবদান রাখেন বলে মনে করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম। তিনি জানান, সরকারিভাবে বরাদ্দ পেলে প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোগত উন্নয়নে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×