ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

অবৈধ সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুদক

তেলে তাদের তেলেসমাতি

গাড়ি, বাড়ি, কমিউনিটি সেন্টার সবই আছে তিন কর্মচারী-কর্মকর্তার

তেলে তাদের তেলেসমাতি

মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, আতিকুর রহমান, কামরুল হোসেন

আহমেদ কুতুব, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:৪১ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ১০:৫২

চট্টগ্রামের পদ্মা অয়েল কোম্পানিতে অস্থায়ী নিরাপত্তাকর্মী পদে ২৩০ টাকা বেতনে যোগদান করেন তিনি। ১৯৮৬ সালে এ পদে চাকরি স্থায়ী হয়। এখন ক্ল্যারিক্যাল সুপারভাইজার পদে চাকরিরত। মাসিক ৪০ হাজার টাকা বেতন পেলেও বসবাস করেন মাসিক ৩০ হাজার টাকা ভাড়ার অভিজাত ফ্ল্যাটে। চলেন ২৪ লাখ টাকার প্রাইভেটকারে।

সামান্য বেতনের চাকরি করলেও তেলের ছোঁয়ায় গাড়ি-বাড়ি, কমিউনিটি সেন্টারসহ পৌনে চার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন পদ্মা অয়েল সিবিএ সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন। সিবিএ নেতা হওয়ার পরই বদলে যায় তাঁর ভাগ্যের চাকা।

শুধু নাছির নন; তাঁর মতো আরও দুই কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের হদিস পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির (এসএওসিএল) ব্যবস্থাপক (উৎপাদন) কামরুল হোসেনের অবৈধ আয় না পেলেও তাঁর স্ত্রী নাসরিন লাকীর বিরুদ্ধে দুদক পৌনে এক কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়েছে। একই প্রতিষ্ঠানের উপ-নিরীক্ষা অফিসার আতিকুর রহমান ২৫ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক। তবে প্রাথমিক অনুসন্ধানে তেলের ছোঁয়ায় তারা নামে-বেনামে বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটি। তাদের সম্পদ বিবরণী যাচাইয়ে নোটিশ জারির সুপারিশও করা হয়েছে। 

দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর উপপরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত সমকালকে বলেন, পদ্মা অয়েলে ছোট পদে চাকরি করলেও সিবিএ নেতা নাছিরের আড়াই কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের সন্ধান পেয়েছি। আরেক তেল কোম্পানি এসএওসিএলের দুই কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের খোঁজ পাওয়ায় তাঁর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে দেখার জন্য তাদের সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারি করার সুপারিশ করা হয়েছে। 

কী নেই কর্মচারী নাছিরের   
সিবিএ নেতা কর্মচারী নাছির চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার চাতুরী চৌমুহনী এলাকায় ৫২ শতক জমির ওপর দ্বিতল শশী কমিউনিটি সেন্টার তৈরি করেছেন। চলাফেরা করেন ২৪ লাখ টাকা মূল্যের প্রাইভেটকারে। তিনি এখন পৌনে ৪ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক। তাঁর নামে ১ কোটি ৭৯ লাখ ১৩ হাজার টাকার জমি-জমা, ভবন, স্থাবর সম্পদ রয়েছে।

আনোয়ারায় ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪ দফায় ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার জমি কেনেন। সম্পদ বিবরণীতে অস্থাবর সম্পদের মধ্যে আসবাব, গবাদি পশু, মাছ চাষে আয় দেখিয়েছেন ১ কোটি ২ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। বাস্তবে এ সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৭০ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। দায়-দেনা বাদে পারিবারিক ও অন্য ব্যয়সহ নাছিরের অর্জিত সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এর বিপরীতে তাঁর ১ কোটি ২০ লাখ ২৭ হাজার টাকা গ্রহণযোগ্য আয়ের প্রমাণ পায় দুদক। অর্থাৎ নাছিরের অবৈধ সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এ ছাড়া ২ কোটি ১১ লাখ ৭১ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপন রেখেছেন বলে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে। তাঁর বিরুদ্ধে পদ্মা অয়েলের কর্মচারীদের বদলি, টেন্ডার, পদোন্নতি নিয়ে ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

অভিযুক্ত সিবিএ নেতা, পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ক্ল্যারিক্যাল সুপারভাইজার নাছির উদ্দিন বলেন, আমি কোনো দুর্নীতি করিনি। যে সম্পদ অর্জন করেছি, তা বৈধভাবে। আদালতে আইনগতভাবে মোকাবিলা করব।

দুদকের উপসহকারী পরিচালক আপেল মাহমুদ বিপ্লব বলেন, সরকারি তেল কোম্পানিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি করে নাছির উদ্দিনের অর্জন করা দুই কোটি ৪৩ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ ক্রোক করা হয়েছে। 

তেল কর্মকর্তার গৃহিণীও কোটিপতি 
রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি এসএওসিএলের ব্যবস্থাপক (উৎপাদন) কামরুল হোসেনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের হদিস না পেলেও তাঁর স্ত্রী নাসরিন লাকীর ৭৯ লাখ ১০ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ রয়েছে। পেশায় গৃহিণী হলেও তিনি পৌনে এক কোটি টাকার মালিক।

দুদক প্রাথমিক অনুসন্ধানে কামরুলের নামে ১ কোটি ৬৮ লাখ ৫৬ হাজার টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ পেলেও কোনো জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পায়নি। কিন্তু লাকীর বিরুদ্ধে ৭৯ লাখ ১০ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে।

এই গৃহিণীর নিজ নামে ৫৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার স্থাবর ও ২৩ লাখ ৬০ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। তাঁর আয়ের কোনো উৎস নেই। ফলে সম্পদ অর্জনের বিপরীতে তাঁর বৈধ ও গ্রহণযোগ্য কোনো আয়ের উৎস পাওয়া যায়নি বলে প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করে দুদক।  

এসএওসিএলের ব্যবস্থাপক কামরুল হোসেন বলেন, আমি ও আমার স্ত্রী অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নই। অভিযোগ মিথ্যা। ষড়যন্ত্রমূলকভাবেই আমাদের এখানে ফাঁসানো হচ্ছে। আমার স্ত্রী নাসরিন লাকী চাকরি করে সম্পদ অর্জন করেছেন। 

উপ-নিরীক্ষকের অবৈধ আয় ২৫ লাখ
আতিকুর রহমান ২০০৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এসএওসিএলে জুনিয়র অ্যাকাউন্টস অফিসার পদে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে উপ-ব্যবস্থাপক নিরীক্ষা পদে চাকরি করছেন। তাঁর নামে ৫৪ লাখ ৩১ হাজার টাকার স্থাবর এবং ৫৩ লাখ ৬৪ হাজার ৪৭৯ টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে।

মোট ১ কোটি ২১ লাখ ৬৪ হাজার টাকার মধ্যে ৩৬ লাখ ২১ হাজার টাকা পারিবারিক ব্যয় করেন। তাঁর দেনার পরিমাণ ৪৭ লাখ ১৩ হাজার টাকা। দুদক প্রাথমিক অনুসন্ধানে তাঁর নিট সম্পদের মূল্য ৬০ লাখ ৮২ হাজার টাকা, পারিবারিক ব্যয় ৩৬ লাখ ২১ হাজারসহ মোট অর্জিত সম্পদের মূল্য ৯৭ লাখ ৩ হাজার টাকা। গ্রহণযোগ্য আয়ের পরিমাণ ৭১ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। তাঁর আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ২৫ লাখ ১০ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদের হদিস পেয়েছে দুদক। 

এ বিষয়ে আতিকুর রহমানের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×