আজ ১১ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ মুক্ত দিবস
ছবি: সমকাল
মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৬:৪৪
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর চূড়ান্ত যুদ্ধে সফলতা অর্জন করে মুক্তিযোদ্ধারা। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে এবং মিত্রবাহিনীর বিমান বহরের হামলার মুখে পড়ে পাকসেনারা মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে পিছু হটে। তারা শহরের হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্পে এবং ধলেশ্বরীর উত্তর প্রান্তের চরে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে বিচ্ছিন্নভাবে ধলেশ্বরী নদী সংলগ্ন নয়াগাঁও এলাকায় মর্টার সেল নিক্ষেপ করতে করতে পাক হানাদার বাহিনী মুন্সীগঞ্জ শহর ছাড়তে শুরু করে। ১০ ডিসেম্বর রাত ৩টায় প্রচণ্ড শীতের ঘন অন্ধকারে মুন্সীগঞ্জে তাদের সুরক্ষিত দুর্গ হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা তা টের পায় ১১ ডিসেম্বর ভোরে। এরপরই জয় বাংলা স্লোগানে বিজয় মিছিলে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে মুন্সীগঞ্জবাসী।
মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন অনু সমকালকে জানান, ৪ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ শহরের অদূরে রতনপুর ও আশপাশ এলাকায় পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধা একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পাকসেনাদের তিনটি বড় দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়ায়। এ সময় পাকসেনারা ধলেশ্বরী নদীতে গানবোট থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে মর্টার সেলিং করছিল। মুক্তিযোদ্ধারাও পাকসেনাদের লক্ষ্য করে মুর্হুমুহু গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে মিত্র বাহিনীর বিমান বহরের হামলায় পাকসেনাদের তিনটি গানবোট বিধ্বস্ত হয়। এতে পাকসেনারা পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পিছু হটতে শুরু করে। এ যুদ্ধে তিন পাকসেনার লাশ পাওয়া যায় এবং স্থানীয় ১৪ থেকে ১৫ জন নিরীহ মানুষ মারা যায়।
তিনি জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সফলতার খবর পেয়ে মুন্সীগঞ্জেও পাকসেনাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধ করতে সদরের ধলাগাওঁ, রামপাল, রতনপুর, মিরকাদিম ও আশপাশে প্রায় সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধা চারিদিকে অবস্থান নেয়। এরপরই ৪ ডিসেম্বর জয়ের মুখ দেখে মুক্তিযোদ্ধারা।
একাধিক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে নির্দেশনার পর ১০ মার্চ মুন্সীগঞ্জে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে মুক্তিপাগল ছাত্র-শ্রমিক-জনতা পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে। ২৭ মার্চ ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, জনতা সিরাজদিখান থানা পুলিশ ক্যাম্পের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। ২৯ মার্চ হরগঙ্গা কলেজে তৎকালীন শহীদ মিনারে লাল সবুজের পতাকা উত্তোলন করা হয়। একই দিন মুন্সীগঞ্জে অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় ছাত্র ও জনতা। ৩১ মার্চ পাকবাহিনী নারায়নগঞ্জে আক্রমণ করলে মুন্সীগঞ্জের দামাল ছেলেরা নারায়নগঞ্জের মানুষের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ৪ ঘণ্টা যুদ্ধে অংশ নেয়। ২০ এপ্রিল পাকবাহিনীর সঙ্গে মুন্সীগঞ্জের মুক্তিপাগল জনতার যুদ্ধ হয়।
এরপর অনেক প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে ৯ মে পাকবাহিনী ঢুকে পড়ে মুন্সীগঞ্জে। তারা গজারিয়ায় হানা দিয়ে ফুলদী নদীর তীরে ৩৬০ জেলে ও কৃষককে ব্রাশফায়ার করে হত্যার মধ্য দিয়ে মুন্সীগঞ্জে প্রবেশ করে। তারা বেশ কিছু বসতবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। গজারিয়ার চর ও জেলে পল্লীর ২’শ নিরীহ মানুষকে হত্যা ও গণহারে নারী ধর্ষণে মেতে ওঠে। ১৪ মে শহরের অদূরে কেওয়ার চৌধুরী বাড়িতে ১৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা ও ৫০ নারীকে ধর্ষণ করে। ধলাগাওঁ গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হানা দিয়ে ১০ নারীকে ধর্ষণ করে। এছাড়া বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জনকে ধরে নিয়ে বটগাছে ঝুলিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা অব্যাহত রাখে হানাদার বাহিনী।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, মুন্সীগঞ্জের মুক্তিপাগল ছাত্র যুবক ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে জুনের শেষের দিকে মুন্সীগঞ্জে ফিরে স্থানীয় ছাত্র ও যুবককে ক্যাম্প থেকে ১৫ থেকে ২০ দিনের গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৫শতে উন্নীত হয়। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়। ১১ আগষ্ট শ্রীনগর থানা, ১৪ আগস্ট লৌহজং থানা দখল করে মুক্তিযোদ্ধারা। সেপ্টেম্বর মাসে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের বাড়ৈখালীর শিকরামপুর হাটে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়।
নবাবগঞ্জ থেকে ৩টি গানবোট বোঝাই পাকসেনারা শিকরামপুরে পৌঁছালে মুক্তিযোদ্ধারা সশস্ত্র হামলা চালিয়ে তিনটি গানবোট নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এ যুদ্ধে শতাধিক পাকসেনা নিহত হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা লৌহজংয়ে গোয়ালীমান্দ্রায় অভিযান চালিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাকসেনাকে হত্যা করে। ২৫ সেপ্টেম্বর সিরাজদিখানের সৈয়দপুর লঞ্চঘাটে যুদ্ধে ৯ পাকসেনা নিহত হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা আরও জানান, অক্টোবর মাসে মিরকাদিম, ধলাগাও, ও টঙ্গিবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় আরও কয়েকটি অপারেশন চালিয়ে সফলতা পান মুক্তিযোদ্ধারা। ৪ নভেম্বর টঙ্গিবাড়ী থানা দখল এবং ৮ ও ১৯ নভেম্বর সিরাজদীখানে দুই দফা আক্রমণে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এছাড়া ১৪ নভেম্বর রাতে ৮৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ৭টি গ্রুপে ভাগ হয়ে তুমুল যুদ্ধের পর মুন্সীগঞ্জ থানা দখলে নিয়ে ২৭টি রাইফেল লুট করে নিয়ে যায়।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, যুদ্ধরত অবস্থায় গজারিয়ায় কমান্ডার নজরুল ইসলাম পাকসেনাদের গুলিতে নিহত হন।
- বিষয় :
- মুন্সীগঞ্জ
- মুক্তিযুদ্ধ