ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

টাকার কুমির হাবিবর ছেলে সনি ভূমিদস্যু

টাকার কুমির হাবিবর ছেলে সনি ভূমিদস্যু

বগুড়ার ধুনটে ২১ শতক জমির ওপর নির্মিত আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি হাবিবরের ছেলে আসিফ ইকবাল সনির বহুতল ভবন সমকাল

 গিয়াস উদ্দিন টিক্কা, ধুনট (বগুড়া)

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:১৩ | আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৬:৩২

পুলিশে চাকরির সময় কামান দু’হাতে। এলাকায় পরিচিতি পান ‘টাকার মেশিন’ নামে। সেই অর্থ ঢেলে ২০০৮ সালে বাগিয়ে নেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন। এর পর থেকে বগুড়া-৫ (ধুনট-শেরপুর) আসনে টানা তিনবার সংসদ সদস্য হয়েছেন হাবিবর রহমান। গত ১৫ বছরে তিনি গড়েছেন অঢেল সম্পদ। কম যাননি ছেলে আসিফ ইকবাল সনি। বাবার ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে স্বল্পমূল্যে ভালো জমি কিনতেন তিনি। নজরে পড়ার পর দিতে না চাইলে তা দখল করে তকমা পেয়েছেন ভূমিদস্যুর।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে পলাতক বাপ-ছেলে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বাপ-ছেলের অঢেল সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে। সংস্থার উপসহকারী পরিচালক কে এম আসাদুজ্জামানের আবেদনে গত ১৭ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।

দুদক বগুড়া কার্যালয়ের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সাবেক এমপি হাবিব ও তাঁর ছেলে সনির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন তারা। বর্তমান বাস্তবতায় অভিযুক্তরা পালিয়ে যেতে পারেন– আশঙ্কা থেকে আবেদন করা হলে আদালতে তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানা যায়, সাবেক এসপি হাবিবর রহমান নৌকার টিকিটে ২০০৮ সালে প্রথম এমপি নির্বাচিত হন। এর পর বাবার ক্ষমতাকে পুঁজি করে আসিফ ইকবাল সনি হয়ে ওঠেন ধুনট-শেরপুরের মূর্তিমান আতঙ্ক। হাবিব কাগজ-কলমে এমপি হলেও সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন ছেলে সনি এবং ছোট ভাই রেজাউল করিম রেজা। দুই উপজেলার বড় বড় জলমহাল দখলে নেন রেজা। টিআর, কাবিখা, কাবিটা, যমুনা-বাঙ্গালী নদী ঘিরে বালু বাণিজ্য, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়োগ বাণিজ্যের বিস্তৃতি ঘটান সনি।

টিনশেড ঘর থেকে বেগমপাড়ায় বাড়ি

২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামায় ব্যাংক ঋণের তথ্য উল্লেখ করেন ৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর ঋণের বোঝা নামিয়ে গত ১৫ বছরে স্ত্রী-ছেলে ও আত্মীয়স্বজনের নামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। সে সময় হাবিব নিজের নামে ৫০ হাজার টাকা মূল্যে ১০ বিঘা কৃষিজমি এবং ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যে ঢাকার দক্ষিণ নিকুঞ্জের ৩/সি নম্বর ব্লকের ৮ নম্বর প্লটে অকৃষিজমি আছে উল্লেখ করেন। নগদ ২৭ লাখ ৭৭ হাজারের বেশি ও ব্যাংকে জমা ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ছিল ২৫ লাখ টাকা। প্রয়াত স্ত্রী খাদিজা হাবিব ও ছেলে সনির নামে কোনো অর্থ-সম্পদ হলফনামায় দেখাননি হাবিব। এমনকি এমপি হওয়ার আগে ধুনটের জালসুকা গ্রামে ছিল একটি আধা-পাকা টিনশেড ঘর।

সমকালের অনুসন্ধানে হাবিবের নামে সিঙ্গাপুরের বেগমপাড়ায় একটি বাড়ি কেনার তথ্য উঠে এসেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাঁর এক আত্মীয় বিষয়টি জানিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির পাশেই বিল বাইশা মৌজায় ১৫০ বিঘা জমি কিনে ‘বাবু পার্ক সিটি ও রিসোর্ট সেন্টার’ করার কাজ শুরু করেছিলেন। এ জায়গার সঙ্গেই দখল করেছেন ১০০ বিঘার জলমহাল। রাজধানীর নিকুঞ্জের পাঁচ কাঠার প্লটে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়েছেন বহুতল বাড়ি। এ ছাড়া রাজধানীর শান্তিনগর ইস্টার্ন হাউজিংয়ে নিজেদের বসবাসের ফ্ল্যাট, আদাবর, উত্তরা ও মোহাম্মদপুরেও একাধিক ফ্ল্যাট কিনেছেন।

হাবিব, স্ত্রী খাদিজা হাবিব, ছেলে সনি ও মেয়ে ফারজানা দিবার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১৮ সালে নড়েচড়ে বসে দুদক। কমিশনের প্রধান কার্যালয়ের তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক নুরুল ইসলাম ওই বছরের ১৯ এপ্রিল তাদের সম্পদের তথ্য চেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেন। তবে হাবিবের দাপটে সে সময় দুদক কর্মকর্তারা অসহায় হয়ে পড়েন এবং বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়।

ভূমিদস্যু সনি

শেরপুরের ধরমোকাম এলাকার অশীতিপর মুনসুর রহমান ব্যাপারী বলেন, ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের পাশে শেরুয়া মৌজায় ১০ কোটি টাকার ৫৮ শতক জমির পৈতৃক সূত্রে মালিক আমি। এমপিপুত্র সনি আমার এক আত্মীয়ের কাছ থেকে ৩৬ শতক জমি কেনেন। পরে আমার পুরো জমি দখল করেন। শুধু তাই নয়, পুলিশ দিয়ে আমাকে পৈতৃক ভিটা থেকে উচ্ছেদ করে সেটিও দখলে নেন। কোটি টাকা মূল্যের জমি হারিয়ে আমি এখন পথের ফকির।

এভাবেই ধুনটের প্রায় ৫০ একর আয়তনের শীতলা বিল দখল করে বছরের পর বছর মাছ চাষ করছেন সনি। এতদিন তাদের বিরুদ্ধে কেউই মুখ খোলার সাহস করেননি। এখন ভুক্তভোগীরা তাদের জমি-জায়গা ফেরত চান। ইতোমধ্যে বাপ-ছেলের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলাও হয়েছে।
এ ছাড়া শেরপুর উপজেলার ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের পাশে খোদ্দর মৌজায় সনির নামে ৫০ বিঘা জমিতে ইটভাটা রয়েছে। শেরপুরের দুবলাইগাড়ি এলাকায় কোটি টাকা ব্যয়ে করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি। ধুনটে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর পূর্ব পাশে ২০১৫ সালে সনি মাত্র ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা দলিলে কেনেন ২১ শতক জমি, যার বর্তমান বাজারমূল্য ২০ কোটি টাকার বেশি। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে জোর করে এ জমি কিনে নেন সনি। বর্তমানে সেখানে কোটি টাকা ব্যয়ে তিনতলা মার্কেট রয়েছে।

আরও পড়ুন

×