এটি ভাগাড় নয়, নদী

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের মোগড়াপাড়া চৌরস্তায় মারীখালী নদে আবর্জনার স্তূপ সমকাল
শাহাদাত হোসেন রতন, সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ)
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:২৪
দূর থেকে দেখে মনে হয় এটি একটি ভাগাড়–পলিথিনসহ নানা ধরনের আবর্জনায় স্তূপ হয়ে আছে। অথচ এর ওপর নির্মিত সেতু দেখে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। সেতুর নিচে আবর্জনার পাশে ছিটেফোঁটা কালচে পানি দেখে এটি নদীর অস্তিত্ব আঁচ করা যায়।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মারীখালী নদীটির এখন এমনই মুমূর্ষু দশা। দখল-দূষণ ও নাব্য সংকটের কারণে নদীটি এখন বিলীনের পথে। এক সময়ের খরস্রোতা এ নদী দিয়ে লঞ্চ যেত মেঘনায়। সেই স্রোতঃস্বিনী তার জৌলুস হারিয়ে এখন মরা খাল।
স্থানীয়রা বলছেন, উপজেলার পৌরসভাসহ চার ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ কৃষিকাজ, গোসলসহ গৃহস্থালি বিভিন্ন কাজে এই নদীর পানি ব্যবহার করত। কিন্তু শিল্পের বর্জ্যে কালচে রং ধারণ করায় এর পানি এখন কোনো কাজে আসে না। দুর্গন্ধে এই নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে চলাও দায় হয়ে পড়েছে। এ নদীকে ঘিরে উপজেলার কমপক্ষে ৩০টি গ্রামের অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে। অথচ প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাওয়ায় নদীটি তার প্রবাহ হারিয়ে যেন অস্তিত্ব বিলীনের দিন গুণছে। মারীখালীর বুক থেকে আবর্জনা অপসারণের দাবি জানিয়ে স্থানীয়রা বলেন, এ বিষয়ে শিগগির ব্যবস্থা না নিলে নদীটি বিলীন হয়ে যাবে।
জানা যায়, উপজেলার বৈদ্যেরবাজার ইউনিয়নের মেঘনা নদীর কোলঘেঁষে শুরু হয়ে কাইকারটক এলাকা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে মিশেছে এ মারীখালী নদী। আট কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও গড়ে ৪২ মিটার প্রস্থের নদীটির ওপর দিয়ে যাতায়াতের জন্য বিভিন্ন স্থানে ছয়টি সেতু নির্মাণ করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) ও এলজিইডি। ময়লা আবর্জনা জমে থাকায় মারীখালী হারিয়েছে তার নাব্য। দূষণের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
স্থানীয়রা জানান, মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা এলাকায় জালাল টাওয়ার, রশিদ সুপার মার্কেট, আম্বিয়া সুপার মার্কেট, সোনারগাঁ শপিং কমপ্লেক্স, ঈশাখাঁ প্লাজা, রহমত ম্যানশন, নুরা বেপারী মার্কেট, আইয়ুব প্লাজা, মদিনা টাওয়ারসহ বিভিন্ন মার্কেটের বর্জ্য মারীখালী নদীর সেতুর নিচে ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়া কাঁচাবাজার, ফলের দোকানসহ আশপাশের বাড়ির আবর্জনা প্রতিদিন নদীতে ফেলা হচ্ছে। ফলে মোগড়াপাড়া থেকে কোম্পানিগঞ্জ আধাকিলোমিটার এলাকাজুড়ে আবর্জনার স্তূপ জমে রয়েছে। প্রতিদিন মারীখালীতে হাট বাজারের বর্জ্য ফেলায় পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দখল, ভরাট ও দূষণের কবলে পড়ে অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে নদীটি। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দুই-চার বছরের মধ্যেই নদীটি পুরোপুরি হারিয়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা। এ ছাড়া প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নদীর দুই পাড় দখল করে দোকানপাট, ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করায় পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। একই সঙ্গে তারা নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে মারীখালী পরিণত হয়েছে ভাগাড়ে।
মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা বাজারের ব্যবসায়ী আলম মিয়া বলেন, মারীখালীর পানির দুর্গন্ধে এলাকায় থাকা যায় না। এ ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
উদ্ভবগঞ্জ এলাকার ব্যবসায়ী আবু সাঈদ বলেন, এ নদীতে বৈদ্যেরবাজার এলাকায় আল মোস্তফা গ্রুপ বালু ফেলে সীমানা প্রাচীর দিয়ে দখল করেছে। সাহাপুর এলাকায় বিভিন্ন করাতকলের বড় বড় গাছের গুঁড়ি ফেলে রাখা হয়েছে। একই এলাকায় শহিদুল ইসলাম শহিদ নদীতে সিমেন্টের খুঁটি দিয়ে দখল করে রেখেছেন। এ ছাড়া মোজাম্মেল হোসেন নামের একজন নদীর তীর দখল করে ভবন নির্মাণ করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন এ বিষয়ে একটি নোটিশ করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছেন। উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার কোনো উদ্যোগ নেই।
অভিযুক্ত শহিদুল ইসলাম শহিদ খুঁটি দিয়ে নদীর জায়গা দখলের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, তাঁর নিজস্ব জায়গায় খুঁটি দিয়েছেন। নদীর জায়গা নদীর মধ্যেই রয়েছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন সোসাইটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন জানান, প্রতিদিন বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও হাটবাজারের আবর্জনা ফেলায় মারীখালী মরা খালে পরিণত হয়েছে। এ নদীতে চৈতী কম্পোজিট ও মেঘনা অর্থনীতি অঞ্চলের বিভিন্ন কারখানার রাসায়নিক মিশ্রিত পানি নদীতে ফেলায় দূষণ হয়েছে। এ নদীর পানি এখন আলকাতরার মতো হয়ে আছে। নদীর বিভিন্ন স্থান দখল করে পাকা ভবন নির্মাণ করেছেন এলাকার কিছু মানুষ। এ নদী রক্ষায় তাদের কার্যক্রম চলবে বলে জানান তিনি।
বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জের যুগ্ম পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মারীখালী নদীটি খননের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে হয়ে ওঠেনি। ড্রেজিং বিভাগের অনুমতি পেলে কাজ শুরু করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সোনারগাঁর ইউএনও ফারজানা রহমান জানান, মারীখালী নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে শিগগির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
- বিষয় :
- নদী