এস আলমের ৯ কারখানা আকস্মিক বন্ধ কেন
বন্ধের নোটিশ দিলেও উল্লেখ নেই বেতন-ভাতার

ফাইল ছবি
আকরাম হোসেন রানা, কর্ণফুলী (চট্টগ্রাম)
প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:১৪ | আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:১২
এস আলম গ্রুপের ৯টি কারখানা এক দিনে আকস্মিক বন্ধ হওয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। এতে কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছেন এসব কারখানার ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক-কর্মচারী। গত মঙ্গলবার আকস্মিক নোটিশে এসব কারখানা বন্ধ হওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ করেন অনেকে। কার্যত এ সিদ্ধান্তে শ্রমিক-কর্মচারীরা চোখে সরষে ফুল দেখছেন।
দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে তিনি এসব দুর্নীতি ও হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় হঠাৎ কারখানা বন্ধ করে দেওয়ায় প্রশ্ন উঠছে– এস আলম গ্রুপ সরকারকে চাপে ফেলতে এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা? নাম প্রকাশ না করে গ্রুপের কর্মকর্তারা বলছেন, কাঁচামালের সংকটে তারা কারখানা বন্ধের পদক্ষেপ নিয়েছেন। তবে শ্রমিকদের দাবি, কাঁচামালের তেমন সংকট ছিল না।
সাধারণত সংকটে পড়া শিল্পপ্রতিষ্ঠান ক্রমান্বয়ে বন্ধ হওয়ার দিকে যায়। এস আলম গ্রুপের কারখানাগুলোর ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায়নি। ৯টি কারখানা এক দিনেই বন্ধ হয়েছে। এ নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে কোনো পূর্ব ধারণা ছিল না। এতে তারা মহাসংকটে পড়েছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের অনেকেই হতাশায় নিমজ্জিত।
কর্ণফুলী উপজেলার এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে জালাল উদ্দীন বাপ্পি ১৮ বছর ধরে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। প্রতিদিনের মতোই গত মঙ্গলবার তিনি কারখানায় কাজ করতে যান। দুপুরে তাঁর চোখ আটকে যায় নোটিশ বোর্ডে। তিনি দেখেন, বুধবার (গতকাল) থেকে তাঁর কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। বেতন-ভাতার কী হবে, সে বিষয়ে নোটিশে কোনো ব্যাখ্যা নেই। এটা ছিল জালালের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো।
শুধু জালাল নন, তাঁর মতো অন্তত ১০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর একই দশা। শ্রমিকদের প্রশ্ন, নোটিশ দিয়ে কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার আগে তাদের বেতন-ভাতার সুরাহা করা উচিত ছিল। এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের শ্রমিক জালাল উদ্দীন বাপ্পি বলেন, কারখানা কখন খুলবে, আমাদের বেতন চলবে কিনা– সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। বেতন না দিলে পরিবার নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব, সেটা চিন্তার বিষয়। দীর্ঘ ১৮ বছরের চাকরিজীবনে এমন কঠিন সময় আর আসেনি।
একই কারখানার শ্রমিক ফারুক হোসেন বলেন, আমি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এখন পরিবার নিয়ে কোথায় যাবি? তাদের কীভাবে খাওয়াবি? সূত্র জানায়, বন্ধ ঘোষিত কারখানাগুলোর শ্রমিকরা ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত কোনো কারখানার পণ্য তারা ডেলিভারি হতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে কর্তৃপক্ষ বরাবর ১০ দফা দাবি পেশ করেছেন।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেড পাওয়ার সাপ্লাই চেইনের সিনিয়র অপারেটর টিপু সুলতান বলেন, ‘আমরা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে কর্তৃপক্ষকে ১০ দফা দাবি জানিয়েছি। আমরা ঘোষিত সাধারণ ছুটি মানি না। ছুটি দিতে হলে নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করতে হবে; ছুটি চলাকালে কারখানার ডেলিভারি বন্ধ রাখতে হবে। এ ছাড়া এক মাসের মধ্যে সবার ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়াও জানুয়ারি থেকে ইনক্রিমেন্ট দিতে হবে। অবশ্যই সাধারণ ছুটি চলাকালে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি বহাল রাখতে হবে।’
ওই কারখানার এক শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কর্তৃপক্ষ বলছে– উৎপাদনের জন্য কারখানায় কাঁচামালের সংকট রয়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি, গুদামে কাঁচামালের যথেষ্ট মজুত রয়েছে। উৎপাদন এবং ডেলিভারিও স্বাভাবিক। তাহলে হঠাৎ করে কেন বন্ধের ঘোষণা? কারখানা শ্রমিক মো. ইসমাইল বলেন, পরিবারের সাত সদস্যের পেটে ভাত যায় আমার বেতন থেকে। এভাবে অনিশ্চয়তায় দিন পার করা আমার ও পরিবারের জন্য কঠিন। দ্রুত সমাধান চাই।
এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মশিউর রহমান বলেন, ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ কারখানা সাধারণ ছুটির ঘোষণায় শ্রমিক-কর্মচারীরা প্রতিবাদ জানিয়ে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পেশ করছেন। তারা শ্রমিকদের দাবিগুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তবে সাধারণ ছুটি চলাকালে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন কর্তৃপক্ষ বহন করবে– এমন একটা বার্তা তারা মঙ্গলবার রাতে পেয়েছেন বলে তিনি জানান।
এস আলম গ্রুপের বন্ধ কারখানাগুলো হলো– এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এস আলম পাওয়ার প্লান্ট লিমিটেড, এস আলম স্টিলস লিমিটেড, এস আলম ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং মিলস লিমিটেড, চেমন ইস্পাত লিমিটেড, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেড, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেড (এনওএফ), এস আলম পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড ও ইনফিনিটি সিআর স্টিপস লিমিটেড।
- বিষয় :
- এস আলম গ্রুপ