প্রভাবশালীর ঝোপে নৌ চলাচল ব্যাহত, মাছ শিকারে বিঘ্ন

কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার কাঁঠালিয়া নদীতে মাছ শিকারের জন্য প্রভাবশালীদের অবৈধভাবে বসানো ঝোপ সমকাল
জুনায়েদ আহমেদ, হোমনা (কুমিল্লা)
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:০০
নদীর বিভিন্ন স্থানে বাঁশ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে কচুরিপানা। স্থানীয়ভাবে এটিকে বলা হয় ঝোপ বা খেও। এভাবে মাছ শিকার করেন স্থানীয় প্রভাবশালী ও এক শ্রেণির জেলে। এতে সংকুচিত হয়ে পড়েছে নৌপথ। এসব ঝোপের বাইরে মাছ শিকার করতে নামলেও অনেক সময় খালি হাতে ফিরতে হয় অন্য মৎস্যজীবীদের। এমন চিত্র কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার মেঘনা ও কাঁঠালিয়া নদীতে।
জানা গেছে, দুই নদীতে অবৈধভাবে দুই শতাধিক ঝোপ তৈরি করে মাছ শিকারের ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে। এসব ঝোপের অধিকাংশই স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তির দখলে। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নেতারা।
নদীপাড়ের মানুষ বলছেন, দেশীয় প্রজাতির মাছ নিধনের এ ফাঁদ সাম্প্রতিক সময় আরও বিস্তৃত হয়েছে। অথচ নদীর সঙ্গে তাদের অনেকের জীবন-জীবিকা জড়িত। কিন্তু দখলের কারণে নৌযান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সংকুচিত নৌপথে দুর্ঘটনাও ঘটছে। চুরি, ছিনতাই ও চোরাচালান বেড়ে যাওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
স্থানীয় একাধিক সূত্র বলছে, উপজেলার চালিভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ সরকারের নিজস্ব এবং আত্মীয়স্বজন কাঁঠালিয়া নদীতে ৩০টির বেশি অবৈধ ঝোপ বসিয়েছেন। এর বাইরে স্থানীয় অনেক প্রভাবশালী লাখ লাখ টাকা খরচ করে ঝোপ বসিয়ে কোটি টাকার ব্যবসা করছেন। এতে পেশাদার জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন। তাদের মাসোহারা দিয়ে নদীতে নামতে হয়।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল লতিফকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নদীতে ঝোপ বসানো এক ব্যক্তির ভাষ্য, ‘পূর্বপুরুষরা এ ব্যবসা করতেন। আমরাও করছি। এটি বন্ধ করলে সবারটা বন্ধ করতে হবে। শুধু আমাদের নয়।’
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদ বলেন, শত শত অবৈধ ঝোপ সরানোর ক্ষমতা তাঁর নেই। আগের ইউএনওদের বললেও তারা পদক্ষেপ নেননি। বর্তমান ইউএনওকেও বলা হয়েছে। অবৈধ ঝোপ যারা দিয়েছেন, তারা অনেক প্রভাবশালী। চালিভাঙ্গা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যানসহ তাঁর ভাই-ভাতিজারা এক থেকে দেড় কিলোমিটার নদীতে অবৈধ ঝোপ দিয়েছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় প্রশাসন মাঝে মধ্যে অভিযান চালালেও প্রভাবশালীদের চাপে তারা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেননি। কাঁঠালিয়া নদীতে ঝোপ বসানোর কারণে মাছের অভয়ারণ্য হুমকির মুখে পড়েছে। প্রকৃত জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে বাধার মুখে পড়লেও ভয়ে মুখ খুলতেও সাহস পান না। তাদের ভাষ্য, নদী রক্ষা ও দেশি মাছের প্রজাতি টিকিয়ে রাখতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় মেঘনার মতো সম্ভাবনাময় উপজেলায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলে শঙ্কা স্থানীয় বাসিন্দাদের।
এসব ঝোপের (খেও) জন্য মাছ ধরতে পারেন না বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় জেলে ইব্রাহিম হোসেন। তিনি বলেন, ‘নদীতে নামতে হলে প্রভাবশালীদের টাকা দিতে হয়। এই টাকা কই থেকে দিমু। মাছ ধরে আমরা সংসার চালাই। কিন্তু নদীতেই আমাদের কোনো অধিকার নাই।’
নদীতে দুই শতাধিক ঝোপ রয়েছে জানিয়ে চালিভাঙ্গা নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. আজমগীর হোসাইন বলেন, নিয়মিত অভিযান চালানো হলেও প্রভাবশালীরা আইন মানছেন না। ইউএনওকে নিয়ে বড় ধরনের অভিযান চালানো হবে।
এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধে মৎস্য কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। অবৈধ ঝোপের তালিকা তৈরি করে জানানো হয়েছে তাদের। এ তথ্য জানিয়ে মেঘনার ইউএনও হ্যাপী দাস বলেন, কয়েক দিন সময় দেওয়া হবে, দখলদাররা যেন অবৈধ ঝোপ সরিয়ে ফেলে। না সরালে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চারজন তহশিলদার কাজ করছেন। মাইকিং করেও জানানো হবে। এর পরও না সরালে অভিযান চালাবেন বলে জানান তিনি।
- বিষয় :
- নদী