ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

রাঙামাটি

তামাক ছেড়ে শিম-বাদামে

তামাক ছেড়ে শিম-বাদামে

এঁকেবেঁকে চলে গেছে রেংখ্যং নদী। পাশের উর্বর জমিতে চাষ চলছে শিমের। রোববার রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া এলাকায়। ছবি: সমকাল

সত্রং চাকমা, রাঙামাটি

প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২৫ | ০২:৪৪

রেংখ্যং নদীর পারে এবার ৬০ শতক জমি বর্গা নিয়েছেন কৃষক বিশ্বান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। তাঁর বাড়ি রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার গোয়াইনছড়িতে। বর্গা নেওয়া জমিতে শিম চাষ করেছেন বিশ্বান্ত। ভালো ফলনের জন্য ভিটামিনও প্রয়োগ করতে হয়েছে তাঁকে। যদিও বর্ষায় আসা পলিমাটির কারণে বেশ উর্বরা রেংখ্যং নদীতীরের জমিগুলো। অতীতে এখানে ব্যাপক মাত্রায় চাষ হতো তামাকের। এক যুগে বদলে গেছে চিত্র। সম্প্রতি দু’দিন ঘুরে এ নদীর প্রায় ৬০ কিলোমিটার অংশের দুই পাশেই কৃষিজমি দেখা যায়। বিপুল ফলনে হাসিও ফুটেছে চাষিদের মুখে।

গোয়াইনছড়ি গ্রামটি উপজেলার দুর্গম ফারুয়া ইউনিয়নে পড়েছে। ফারুয়ার কিষানি ইনোচিং মারমা (৩২) সোমবার বলছিলেন, পুরো এলাকায়ই কৃষকেরা শিমসহ নানা জাতের সবজি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তিনি গত বছর সামান্য জমিতে চাষ করেন। এবারও করেছেন। চলতি মৌসুমে ফলন আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এ মৌসুমে বিলাইছড়ির ফারুয়া ইউনিয়নে লতাজাতীয় দেশীয় শিম চাষ হয়েছে ৭৫ হেক্টর জমিতে। এ ছাড়া ৩০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে ফরাস শিমের। এ ছাড়া ২২৬ হেক্টর জমিতে অন্যান্য সবজি, ৬৫ হেক্টর জমিতে চীনাবাদাম ও ২৬ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছে। 

এগুজ্জেছড়ির হেডম্যানের দায়িত্বে থাকা কৃষক সমূল্য তঞ্চঙ্গ্যার ভাষ্য, তাদের জরিপে ফারুয়া এলাকায় রেংখ্যং নদীতীরের ১৮০০ হেক্টরের বেশি জমিতে শিম, বাদাম ও সবজির চাষ হয়েছে। অথচ এসব জমিতে ১৯৮০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তামাকের চাষ হতো। সমূল্য তঞ্চঙ্গ্যা নিজেই চার একর জমিতে শিম ও বাদাম ফলাচ্ছেন ৯ বছর ধরে। বছরে গড়ে ৮ লাখ টাকা আয় হয় তাঁর। জমির আয় থেকেই স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ের সংসার ভালোমতোই সামলাতে পারছেন। একমাত্র মেয়েটিকে পড়াচ্ছেন রাঙামাটির কলেজে। যদিও এবার কিছুটা দুশ্চিন্তার কথা জানান সমূল্য। তাঁর প্রায় দুই একর জমির শিমক্ষেত ইঁদুরের কারণে নষ্ট হয়েছে। এ জন্য কৃষি অফিসের সহায়তা চান। 

গত রবি ও সোমবার সরেজমিন ফারুয়ার চাষিদের এই পরিবর্তিত জীবনের চিত্র দেখা যায়। বিলাইছড়ি উপজেলা সদর থেকে ফারুয়া বাজার পর্যন্ত রেংখ্যং নদীর দুই তীরেই শীতকালীন নানা শাকসবজি চাষ করতে দেখা যায়। দিগন্তজুড়ে শুধুই সবুজের সমারোহ। নদীর দুই ধারে কোথাও পতিত জমি নেই। একসময় কৃষকরা না বুঝে লাভের আশায় তামাকের চাষ করতেন এসব জমিতে। ক্ষতির কথা জানতে পেরে তারা আগ্রহ হারান। পরে শিমসহ সবজি চাষ শুরু করেন। এখন নদীর দুই পাড়ে কোথাও তামাকের চিহ্ন নেই। চাষিরা জানান, শিমসহ শাকসবজি একই জায়গায় দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করতে পারেন। ফলে লোকসানের আশঙ্কা কমেছে। ইতোমধ্যে ফরাস শিম তোলা শুরু করেছেন। দেশীয় শিমের ফুল ও ফলন ধরছে। মাসখানেক পর এই শিম তোলা যাবে। ফরাস শিম তারা মণপ্রতি বিক্রি করে আয় করছেন তিন হাজার টাকা। সরাসরি মাঠ থেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

গোয়ানছড়ির কৃষক মিলন তঞ্চঙ্গ্যা গত বছর দুই একর জমিতে শিম চাষ করেন। ফলন পেয়েছিলেন ২৫ মণ। বিক্রি করে তাঁর আয় হয়েছিল সোয়া লাখ টাকার মতো। এ বছরও দুই একর জমিতে শিম চাষ করেছেন মিলন। ফলন ভালো হলে দেড় লাখ টাকা বিক্রি করতে পারবেন– এমন আশা করছেন। মিলন তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘একসময় তামাক চাষ করেছি। তবে তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক জানতে পেরে আমরা সবাই এখন তামাকের বদলে শিম, বাদামসহ অন্যান্য সবজি চাষ করছি।’

বড়হুল তঞ্চঙ্গ্যা নামে আরেক চাষি গত বছর দেড় কানি জায়গায় শিম চাষ করে লাখখানেক টাকা আয় করেন। এ জমির আয়েই পরিবার চলে তাঁর। তবে এ বছর ফলন তেমন হবে না বলে উল্লেখ করেন বড়হুল। তাঁর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, জমি ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারছেন না। কৃষি অফিস থেকে লোকজন দেখে গেলেও তেমন সহায়তা পাচ্ছেন না। তারপরও শিম বিক্রি করে লাখের কাছাকাছি টাকা পেতে পারেন তিনি।

ফারুয়া ইউপি চেয়ারম্যান বিদ্যালাল তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, তাঁর ইউনিয়নের মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। একসময় এখানে প্রচুর তামাক চাষ হতো। তামাক কোম্পানির লোকজন স্থানীয় লোকজনকে বিনা সুদে ঋণ দিয়ে তামাক চাষ করাতেন। ১০-১৫ বছর ধরে কৃষকরা তামাক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেন। এখন তাদের জমিতে শিম ও চীনাবাদামের চাষ হচ্ছে প্রচুর। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর শিমের ফলন ভালো হবে। 

ওই এলাকায় ফলন ভালো হওয়ার কারণ জানা যায় রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত উপপরিচালক তপন কুমার পালের কথায়। তিনি বলেন, ফারুয়ায় রেংখ্যং নদীর দুই পাশে বর্ষাকালে পানি বাড়ার সময় প্রচুর পলি জমে। পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব চর বা জমিতে শিম ও বাদামের আবাদ করেন চাষিরা। তাই ফলনও ভালো হয়। শিমচাষ এখন ফারুয়া এলাকার জন্য নতুন পরিচিতি দিয়েছে। অথচ একসময় এ ইউনিয়নের তামাকের চাষ হতো ব্যাপক মাত্রায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে শিম ও বাদাম চাষ সম্প্রসারণে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। পলি জমার কারণে জমি উর্বর থাকে। তাই অল্প পরিশ্রমে কৃষকরা শীতকালীন শিম উৎপাদনে সাফল্য পান। 

আরও পড়ুন

×