ঢাকা রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

ক্লোজার নিয়ে দুশ্চিন্তা হাওরে

ক্লোজার নিয়ে দুশ্চিন্তা হাওরে

হাওরাঞ্চলে বাঁধের কাজ শুরু হলেও এখন পর্যন্ত মাটি পড়েনি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ঘিলোটিয়া খালে। ছবিটি মঙ্গলবার তোলা- সমকাল

পঙ্কজ দে, সুনামগঞ্জ

প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২৫ | ০২:৫৩

অকাল বন্যা থেকে হাওরাঞ্চলের বোরো ফসল রক্ষায় সুনামগঞ্জে এবার ৬৭৫টি প্রকল্পের আওতায় ৫৮৮ কিলোমিটার বাঁধের কাজ হবে। এর মধ্যে ক্লোজার নামে পরিচিত বড় পরিসরের ভাঙন অংশ ১০৫টি। এসব ক্লোজারে কাজের গতি নিয়ে অসন্তুষ্ট কৃষকরা।

হাওরে ক্লোজার বলতে বোঝায় নদীর মাঝখানে আড়াআড়িভাবে বা খালের মুখে মাটির অস্থায়ী বাঁধ দিয়ে বন্ধ করা। বাঁধের কোনো অংশ দিয়ে পানি ঢুকে ভাঙনের কারণে এসব ক্লোজার সৃষ্টি হয়। এসব ক্লোজারকে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে করা হয় বাঁধের কাজ।

এবার হাওর এলাকায় এ ধরনের ক্লোজার শনাক্ত করা হয়েছে ১০৫টি। এই ক্লোজারগুলোর মধ্যে মঙ্গলবার পর্যন্ত মাত্র ১৫টিতে কাজ শুরু করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। তবে স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, আরও কম ক্লোজারে কাজ চলছে। কাজের গতি বেশ মন্থর।

সুনামগঞ্জের চার লাখ কৃষক পরিবারের ১০ লাখ মানুষ বোরো চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত। এবার ২ লাখ ২৩ হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে ১৩ লাখ ৭৭ হাজার টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে কৃষি বিভাগের। টাকার অঙ্কে এই ধানের মূল্য সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। 

কৃষি অফিসের হিসাব অনুযায়ী, মঙ্গলবার পর্যন্ত ৬৫ হাজার ৬১৪ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ শেষ হয়েছে। হাওরে এখন বোরো চাষের ভরা মৌসুম। হাওরের ক্লোজারে এই সময়ে মাটি পড়তে না দেখলে, দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে কৃষকের কপালে। তারা মনে করেন, ক্লোজার বন্ধ না হলে কষ্টের ফসল অকাল বন্যায় ভেসে যেতে পারে।

২০১৭ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি জেলার ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার তাল হাওরে পানি ঢুকেছিল। ক্লোজারে মাটি পড়া শুরু হবার আগেই এই বিপর্যয় ঘটে। এরপর একে একে ডুবে গিয়েছিল সবকটি হাওর। ওই বছর হাওরের প্রায় সবকটি ক্লোজারই অরক্ষিত ছিল। এবার এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্লোজারে কাজ শুরু করতে পারেনি হাওর রক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটি এবং পাউবো।

সুনামগঞ্জের হাওর রক্ষা বাঁধের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজার হিসেবে পরিচিত জামালগঞ্জের বৌগলাখালি বাঁধ। এই উপজেলাসহ সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার চার উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত পাগনা হাওরের আলীপুর গ্রামসংলগ্ন এই ক্লোজারের কাজ শুরু হতে আরও অন্তত ১০ দিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা পাউবোর দায়িত্বে থাকা উপসহকারী প্রকৌশলী।

সোমবার ওই ক্লোজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ক্লোজারের যে অবস্থা, তাতে গভীর ও দীর্ঘতম এই বাঁধ মেরামতে দেরি হলে বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। তবে এখানে পানি নিষ্কাশনের সময় দিতে গিয়ে টেকসই বাঁধ নির্মাণকাজ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। 

বৌগলাখালিসহ উপজেলার পাঁচটি হাওরের মধ্যে উদ্বোধনী বাঁধ হিসেবে পরিচিত ৩০ নম্বর প্রকল্পের পাগনার হাওরের গজারিয়ার আগের বাঁধ। এই একটি বাঁধ ছাড়া অন্য কোনো বাঁধের কাজ শুরু হয়নি। এই নিয়ে কৃষকের মাঝে অস্বস্তি কাজ করছে।

জামালগঞ্জের ছোট-বড় ছয়টি হাওরে ২৫ হাজার ৩৪২ জন কৃষক বোরো আবাদ করেন। এর মধ্যে পাগনা হাওরের প্রায় ১২ হাজার কৃষকের ফলন নিরাপত্তায় বৌগলাখালি বাঁধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগাম বন্যা কিংবা পাহাড়ি ঢলে বৌগলাখালি বাঁধ ভেঙে গেলে পাগনা হাওরের ৭ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমির ফলন নিশ্চিতভাবেই তলিয়ে যাবে। নদীসদৃশ এ বাঁধ মেরামতে কর্তৃপক্ষ আরও সময় চাইলেও যথাসময়ে এর কাজ শেষ হওয়া নিয়ে জামালগঞ্জ, দিরাই, ধর্মপাশা এবং নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার হাজারো কৃষকের দুশ্চিন্তা আছে।

সোমবার বৌগলাখালি বাঁধ পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, গত বছরের মেরামত করা বাঁধটি এ বছর নদীতে পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেছে। নদীর উভয় পাড়ে একাধিক ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। সুরমা নদী থেকে খানিক ভেতরের যে অংশে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল, সে জায়গাটি গভীর নদীপথে রূপ নিয়েছে। দুই পারের দূরত্ব অনুমান করলে বোঝার উপায় নেই যে, গত বছরই এর কাজ করা হয়েছে।

এ বছরও পাগনা হাওরের নদীসদৃশ ভয়াবহ এই ভাঙন সংস্কার ও মেরামত করা হবে। এরই মধ্যে বাঁধের কাজ শুরুর পর পেরিয়ে গেছে ১৬ দিন। অতিঝুঁকিপূর্ণ এ ক্লোজার ভরাট এবং টেকসই মেরামতের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হলেও এই ক্লোজারের আশপাশে মেরামত কাজের কোনো আলামত নজরে আসেনি।

পাগনা হাওরে জমি আছে, এমন কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৌগলাখালি বাঁধের ওপর নির্ভর করে পুরো পাগনা হাওরের নিরাপত্তা। গত বছরের বাঁধ ভেঙে যেভাবে নদীতে মিশে গেছে, এ বছর সেই বাঁধ মেরামত করতে অনেক সময় দরকার। এ ব্যাপারে এখনও কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। বর্ধিত সময়েও বিপজ্জনক এই ক্লোজার মেরামত করা সম্ভব না।

খালিয়াজুরী উপজেলার মুকিমপুর গ্রামের কৃষক সুধাংশু চন্দ্র বিশ্বাস জানান, কাজের পনেরো দিন চলে গেছে। এর বেশি দেরি হলে ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে। এতে কৃষকের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।

পাগনা হাওরপাড়ের কৃষক অঞ্জন পুরকায়স্থ জানান, হাওরের পানি নিষ্কাশনের অন্যতম পথ বৌগলাখালি। জলাবদ্ধতা নিরসনে এখানকার বাঁধের কাজ শুরু হতে একটু সময়ের দরকার। তবে বেশি দেরি হলে কাজ সময়মতো শেষ করা যাবে না। এতে ঝুঁকিতে পড়বে হাওর।

উপজেলায় পাউবোর দায়িত্বে থাকা উপসহকারী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম জনি জানান, অন্য বাঁধ থেকে বৌগলাখালি একটু ভিন্ন। প্রতিবছর এ বাঁধের কাজ একটু বিলম্বে শুরু হয়। এটি শুধু বাঁধ নয়, এই ক্লোজার দিয়ে পানি নিষ্কাশনও হচ্ছে। অনেক হাওরের পানি এই পথ দিয়ে নামে। পানির গতি কমলেই কাজ শুরু হবে। এতে অন্তত আরও ১০ দিন সময় দরকার। তবে নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে ক্লোজারের কাজ।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লোজারের ব্যাপারে দিরাই উপজেলার সরমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস ছত্তার জানান, আশপাশের কয়েকটি হাওরের ফসল রক্ষা করতে মাছুয়ার খাড়ার বাঁধ নির্মাণ করা জরুরি। এই বাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে শ্যামারচর পর্যন্ত যায়। মঙ্গলবার পর্যন্ত মাছুয়ারখাড়ায় কাজ শুরু হয়নি।

মাছুয়ারখাড়ার পাশে জমি আছে, এমন একজন কৃষক জানান, এই ক্লোজারে এখন মাটির কাজ করতে কোনো রকমের সমস্যা নেই। যে কোনো সময় কাজ শুরু করা যায়।

শাল্লার উদগল হাওরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘিলটিয়া খালের মুখে এখনও কাজ শুরুর কোনো লক্ষণ নেই। পাশের রামপুরের কৃষক কৃপেশ দাস জানান, দাড়াইন নদীতে পানি এলেই এই বাঁধে কাজ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। নরম বাঁধ হলেও ঝুঁকি থাকে। এখনই এই ক্লোজারে কাজ করার উপযুক্ত সময়।

এদিকে তাহিরপুরের শনির হাওরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আম্মকখালীর ক্লোজারে এবার প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) নয়; কাজ করবে ঠিকাদার। ওখানে ব্লক নির্মাণের কাজ চলছে ঢিমেতালে। এমনটাই জানালেন মারহালার কৃষক শামীম আহমদ। তিনি বলেন, ঠিকাদার গাফিলতি করলে বোরো ফসলের সর্বনাশ হবে।

জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক আনিসুল হক জানান, গেল দুই বছর সুনামগঞ্জে অকাল বন্যা হয়নি। নির্বিঘ্নে বোরো ধান গোলায় তুলেছেন কৃষকরা। হাওরাঞ্চলে দুই-তিন বছর পরপর বন্যা হওয়ার রেকর্ড আছে। এবার সব ক্লোজারের কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে।

জেলা সিপিবির সভাপতি এনাম আহমদ জানান, ঠিকাদার কিংবা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) লোকজন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হাওরের ফসল রক্ষা বা মানুষের বিপদে পড়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন না। এবারও সে রকমই দেখছি। পাউবোর সক্রিয়তা নিয়ে কথা হচ্ছে। তবে এর সঙ্গে যুক্ত সবাইকেই তৎপর হতে হবে।

সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান, গুরুত্বপূর্ণ সব ক্লোজারে দ্রুত কাজ শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আম্মকখালী ক্লোজারের ঠিকাদারকেও ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত ১০৫টি ক্লোজারের মধ্যে ১৫টিতে কাজ শুরুর কথা জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।
 

আরও পড়ুন

×