ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

তিনটি বীজ বদলে দিল পাহাড়ি মানুষের জীবন

তিনটি বীজ বদলে দিল  পাহাড়ি মানুষের জীবন

শেরপুরের গারো পাহাড় এলাকায় শিম তুলছেন দুই নারী সমকাল

শেরপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ | ১১:৩১

২৫ বছর আগেও শেরপুরের গারো পাহাড়ে ফসল হতো না। তিন বেলা খাবার জুটত না অনেকের। পাহাড়ি মাটির নিচে ছিল পাথর ও বালু। সেখানে মাত্র তিনটি শিমের বীজ পাল্টে দিয়েছে গারো পাহাড়ের জীবনমান।
২০০০ সালে ভারতের আসামে এক আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে যান ঝিনাইগাতী উপজেলার হলদি গ্রামের বাসিন্দা আয়াতুন্নেছা নামে এক নারী। সেখানে দেখতে পান প্রচুর শিম চাষ। একটি শিম থেকে তিনটি বীজ কাপড়ের আঁচলে করে নিয়ে আসেন বাড়িতে। পরে বীজ তিনটি বপন করেন তিনি। বীজ থেকে গাছ হয়। বেশ ভালো ফলন হয় শিমের। এ খবর চাউর হলে আস্তে আস্তে পুরো গারো পাহাড়ে তা জানাজানি হয়। শুরু হয় শিম চাষ। সেই গারো পাহাড় এখন শিমের রাজ্য। বর্তমানে ৬২০ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে শিম। ভালো ফলন ও দাম পেয়ে খুশি স্থানীয় কৃষক।
চলতি বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় প্রচুর শিম হয়েছে। বাজারে ভালো দাম পেয়ে কৃষক বেশ খুশি। এলাকার কৃষক জানান, বর্তমানে কেরালা, নলডুগ ও গুতুম জাতের শিমের চাষ করছেন তারা। আগাম জাত এবং ফলন ভালো হওয়ায় কেরালা শিম চাষে অনেক লাভ।

শেরপুরের শিমপল্লি হিসেবে পরিচিত ঝিনাইগাতী উপজেলার গারো পাহাড়ের সন্ধ্যাকুড়া গারোকোনা, গোমরাহ, ফাকরাবাদ, ভারুয়া এলাকায় গাছে গাছে শিমের দেখা মেলে। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শিম আর শিম। যেদিকেই তাকানো যায় শুধু শিমের ক্ষেত চোখে পড়ে। থোকা থোকা শিম ঝুলছে। কেউ ক্ষেতে পরিচর্যা করছেন, কেউ শিম তুলছেন, আবার কেউ শিম বিক্রির জন্য ছুটছেন বাজারে।
এসব এলাকার উঁচুনিচু জমি ২৫ বছর আগেও পতিত থাকত। অভাব-অনটন ছিল এখানকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। পাহাড় থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে বিক্রি, পাথর ভাঙা, লাল বালু তোলার শ্রমিকের কাজ করে অধিকাংশের জীবিকা জুটত। কিন্তু শিম চাষ করে বর্তমানে এসব এলাকার কৃষকের জীবন বদলে গেছে। যে জমিতে একমাত্র কাসাভা ছাড়া কোনো ফসল হতো না, সেই জমিতে নিরলস পরিশ্রমে বছরব্যাপী বিভিন্ন জাতের সবজি ফলছে। সচ্ছলতা এসেছে চাষিদের সংসারে।

শিম বিক্রির জন্য চাষিদের এখন দূরে যেতে হয় না। কাছেই সীমান্ত সড়কে গারোকোনা চৌরাস্তায় গড়ে উঠেছে সবজির হাট। যেখানে প্রতিদিন ভোর ৬টার মধ্যে পাইকারি ও খুচরা সবজি বিক্রির জমজমাট বাজার বসে। এখান থেকে পাইকাররা শিম কিনে ট্রাক-পিকআপে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বিক্রি করেন।
ফাকরাবাদ গ্রামের চাষি আব্দুল জলিল জানান, ১২ শতাংশ জমিতে আগাম কেরালা শিম চাষ করে ১ লাখ টাকা বিক্রি করেছেন। আরও ২০ হাজার টাকা বিক্রির আশা করছেন।
কৃষক মুক্তার আলীর ভাষ্য, তিন বিঘা জমিতে কেরালা, নলডুগ ও গুতুম জাতের শিমের চাষ করেছেন। নলডুগ শিমের মাত্র উৎপাদন শুরু হয়েছে। গুতুম এখনও উৎপাদন শুরু হয়নি। ফুল এসেছে। আগাম জাতের কেরালা ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং নলডুগ শিম ২০ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন। আরও অন্তত ৪ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারবেন তিনি।
গারোকোনা বাজারে শিম বিক্রি করতে আসা কৃষক আব্দুল মিয়া জানান, ২৫ শতাংশ জমিতে শিম চাষ করেছেন। এখন পর্যন্ত ৬০ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন। গাছে আরও প্রচুর শিম আছে। শিম লাভজনক ফসল।
শেরপুরের প্রবীণ সাংবাদিক সুশীল মালাকার বলেন, ‘জানি না আয়াতুন্নেছা বেঁচে আছেন কিনা। কিন্তু এই নারী গারো পাহাড়ের মানুষের ভাগ্য বদলের কান্ডারি। তিনি শিমের তিনটি বিচি (বীজ) এনে মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছেন।’
শেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন জানান, পাহাড়ি মাটি সবজি চাষের উপযোগী। এখানকার কৃষক আগাম সবজি চাষ করেন। এ বছর ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী ও সদর উপজেলায় ৬২০ হেক্টর জমিতে শিম চাষ হয়েছে। 

আরও পড়ুন

×