রোগ শনাক্তে বছর পার চিকিৎসায় নিঃস্ব পরিবার
৪ জানুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস

.
মুরাদ মৃধা, নাসিরনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৩:৩৭
জটিল রোগে আক্রান্ত রোকেয়া বেগম। দুই বছর স্থানীয় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরেছেন রোগের নাম জানতে। কিন্তু রোগ শনাক্ত হচ্ছিল না। এদিকে ধীরে ধীরে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন রোকেয়া। অবশেষে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ৪০টি পরীক্ষার পর জানতে পারেন, তিনি স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত। এরই মধ্যে নিজের গহনা ও স্বামীর ভিটা বিক্রি করে হয়েছেন নিঃস্ব। বর্তমানে ঢাকায় তাঁর স্বামী সবজি বিক্রি করে রোকেয়ার চিকিৎসা করাচ্ছেন।
রোকেয়ার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার চাপরতলা ইউনিয়নের কালীউতা গ্রামে। ক্যান্সারের চিকিৎসা নাসিরনগর বা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কোথাও নেই। রোকেয়ার মতো ক্যান্সার আক্রান্ত অনেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করেও জানতে পারছেন না তিনি কোন রোগে আক্রান্ত। যখন জানতে পারছেন, তখন ভিটেমাটি বিক্রি করে হচ্ছেন সর্বস্বান্ত। আর চিকিৎসা করাতে গিয়ে পরিবারকেও নিঃস্ব হতে হচ্ছে।
সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত দুই বছরে নাসিরনগর উপজেলায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন ১৫৯ জন। যাদের অধিকাংশই রোগ শনাক্তের আগেই বসতভিটা বিক্রি করে নিঃস্ব হয়েছেন। পরে রোগের কথা জানতে পেরেও আর্থিক সংকটের কারণে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। সমাজসেবা কার্যালয়ের হিসাবে উপজেলায় গত দুই বছরে ১০৯ জন ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে আর্থিক অনুদান চেয়েছেন।
সমাজসেবা কার্যালয়ে আর্থিক সহযোগিতার জন্য আবেদন করা রোগীদের মধ্যে শূন্য থেকে ৫ বছরের রোগী ৪ জন, ১০ থেকে ৪০ বছরের ২৬ জন। ৪১-এর ঊর্ধ্বে ৭৮ জন। আবেদনকারীদের মধ্যে ৫৮ জন পুরুষ এবং ৫১ জন নারী। পুরুষ রোগীদের মধ্যে ৬০ ভাগ ফুসফুস এবং নারীদের ৯০ ভাগই স্তন এবং জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত। তবে রোগী ও তাদের স্বজনদের ভাষ্যমতে, ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা সমাজসেবার কার্যালয়ের দেওয়া তালিকার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হবে। যারা দরিদ্র, কেবল তারাই সমাজসেবা অফিসে আবেদন করছেন। আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিরা চিকিৎসা সহায়তার আবেদন করেননি। তাই প্রকৃত সংখ্যা আরও কয়েক গুণ হবে বলে ধারণা তাদের।
নাসিরনগরে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কয়েকশ হবে বলে ধারণা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অভিজিৎ রায়ের। এ রোগটি ডায়াবেটিসের মতোই দ্রুত ছড়াচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। এর অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি জানান, ধূমপান এবং মাদকের কারণে প্রায় ৫০ ভাগ মানুষের ফুসফুসের ক্যান্সার হচ্ছে। বাকি ৫০ ভাগ লোকের দূষণ ও ভেজাল খাদ্যাভ্যাসজনিত কারণে হচ্ছে।
শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সাইফুল ইসলামের ভাষ্যমতে, ক্যান্সার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপান, মুখে তামাক গ্রহণ, পরিবেশদূষণ ছাড়াও খাদ্যে ভেজালসহ শাকসবজি-ফলমূলে কীটনাশক প্রয়োগ। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে ক্যান্সারে আক্রান্তের হার কিছুটা হলেও কমবে বলে তাঁর ধারণা।
উপজেলায় ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা জানতে এ প্রতিবেদক ধরমণ্ডল, চাতলপাড়, কুণ্ডা, গোয়ালনগর ও নাসিরনগরের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষকের কাছ থেকে তথ্য নেন। এতে কেবল ওই পাঁচটি ইউনিয়নেই গত এক বছরে ৬৫ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানা গেছে। যাদের অধিকাংশই রোগ শনাক্তের আগেই বসতভিটা বিক্রি করে নিঃস্ব হন। পরে রোগ শনাক্তের পরও অনেকে আর্থিক সংকটে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।
উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের ক্যান্সার আক্রান্ত যুবক মো. রায়হান আহমেদের (২৫) সঙ্গে এ প্রতিবেদকের আলাপ হয়। রায়হান বলেন, তিনি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। ঘরে বৃদ্ধ মা ও ছোট ভাইবোন আছে। তাঁকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে জমিজমা সব বিক্রি করে তাঁর পরিবার এখন নিঃস্ব।
চাপরতলা ইউনিয়নের ক্যান্সার আক্রান্ত এক রোগীর বাবা জানান, তাঁর মেয়ের রোগের বিষয়টি নিশ্চিত হতে সময় পার হয়েছে দেড় বছর। এর মধ্যেই ১৮ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সম্পূর্ণ সুস্থ হতে আরও অনেক টাকা লাগবে।
ধরমণ্ডল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিক মিয়া জানান, তাঁর ইউনিয়নে ২০ জনের মতো ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর তথ্য আছে। এর মধ্যে অনেকেই মারা গেছেন।
চাতলপাড় ইউনিয়নে গত এক বছরে ১০ জন ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৬ জন ইতোমধ্যে মারা গেছেন। বাকি চারজন চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানালেন ওই ইউপির চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম।
কুণ্ডা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাছির উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, তাঁর ইউনিয়নে গত এক বছরে ১১ জনের মতো ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে অধিকাংশ রোগীই আর্থিক সংকটের কারণে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সিভিল সার্জন ডা. নোমান মিয়া সমকালকে বলেন, তাদের কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সঠিক হিসাব নেই। সমাজসেবা কার্যালয়ে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর আবেদন দিয়ে প্রকৃত রোগ শনাক্ত করা সম্ভব নয়। এর বাইরে বহু গুণ রোগী থাকতে পারে বলে তাঁর ধারণা। বিশেষ করে মেয়েদের জরায়ু ও স্তন ক্যান্সার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ জানিয়ে এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
- বিষয় :
- দিবস