ঢাকা রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

ব্যবহারের অনুপযোগী কোটি টাকার ৪২ শৌচাগার

ব্যবহারের অনুপযোগী কোটি টাকার ৪২ শৌচাগার

দেড় বছর আগে নির্মিত চারঘাটের ঝিকরা কমিউনিটি ক্লিনিকের শৌচাগারে তালা ঝুলছে সমকাল

 সনি আজাদ, চারঘাট (রাজশাহী)

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৩:৪০

৮০ বছরের মাজেদা বেওয়া। গত বৃহস্পতিবার চারঘাটের ঝিকরা কমিউনিটি ক্লিনিকে এসেছিলেন পেটের সমস্যা নিয়ে। ক্লিনিকের ভেতরে প্রবেশ করতেই টয়লেটের চাপ আসে তাঁর। তবে ক্লিনিকে নতুন শৌচাগার থাকলেও তা ব্যবহারের উপযোগী ছিল না। ফলে তাঁকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে নিজ বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যান স্বজনরা। এতে সেবা না নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয় মাজেদার।
সেবার উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় রাজশাহীর চারঘাট ও বাঘার কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। বিপরীতে গ্রামীণ ওষুধের দোকানে চিকিৎসা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। অথচ দুই উপজেলার কমিউনিটি ক্লিনিকে কোটি টাকা খরচ করে শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণে ত্রুটি ও অনিয়মের কারণে ব্যবহারের উপযোগী না হওয়ায় অধিকাংশই পড়ে আছে। এতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কমিউনিটি ক্লিনিকমুখী করার সরকারি উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানা গেছে, গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার প্রকল্পের (কাবিটা) আওতায় ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজশাহী-৬ আসনের এ দুই উপজেলায় ৪২টি ক্লিনিকে শৌচাগার (ওয়াশব্লক) নির্মাণ করা হয়। এতে ব্যয় হয় ১ কোটি ৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। প্রতিটিতে আড়াই লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। নারী ও পুরুষদের জন্য পৃথক টয়লেট, ওয়াশ রুমের পাশাপাশি এতে হাত ধোয়ার বেসিন রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ২০২২ সালে নির্মাণকাজ শেষ করে।
২০২০-২১ সালে এ সংসদীয় আসনে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারে বরাদ্দের পুরো টাকা এসব শৌচাগার নির্মাণে ব্যয় করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, টাকা খরচের জন্য তড়িঘড়ি করে লোক দেখানো এ প্রকল্প নেওয়া হয়। ক্লিনিক পরিদর্শন কিংবা সার্বিক অবস্থা যাচাই-বাছাই না করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। নির্মাণের সময়ও ক্লিনিকে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ কাজ হয়েছে। প্রায় সব শৌচাগার অব্যবহৃত পড়ে আছে।
ঝিকরা কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) আকতার বানুর ভাষ্য, দুই-আড়াই বছর আগে শৌচাগারের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। তারপর থেকে তালাবদ্ধ। চাবিটাও দিয়ে যায়নি। একদিনও ব্যবহার করা হয়নি। প্যান, পানির লাইন, টাইলস– সবই নিম্নমানের। রোগীরা কষ্ট পেলেও শৌচাগার ব্যবহার করতে পারেন না।
শৌচাগার নির্মাণ করলেও পানির ব্যবস্থা নেই বলে জানান বাঘার আড়পাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার ফিরোজা খাতুন। তিনি বলেন, ক্লিনিকের ভেতরে একটি টয়লেট আছে, সেটা তারা ব্যবহার করেন। রোগীদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। এজন্য মাঝেমধ্যেই রোগীদের নিয়ে খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
সরেজমিনে কয়েকটি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শনে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্লিনিকের শৌচাগারে তালা ঝুলছে। তালায়ও মরিচা ধরেছে। নির্মাণের দুই বছর পার হলে অধিকাংশই কর্তৃপক্ষ বুঝে পায়নি। যেগুলো দেওয়া হয়েছে, তাও ব্যবহার করতে পারছেন না। কোনোটাতে পানির কোনো ব্যবস্থা নেই, আবার কয়েকটিতে ব্যবস্থা থাকলেও তা নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েকটিতে পানির লাইন ও শৌচাগারের প্যান ত্রুটিপূর্ণভাবে স্থাপন করায় তা ব্যবহারের উপযোগী নয়। আগে স্থাপিত নলকূপের ট্যাঙ্ক থেকে শৌচাগারে পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
গ্রামের নারীরা কমিউনিটি ক্লিনিকে যেতে চান না বলে জানান চারঘাটের হাবিবপুর গ্রামের মোত্তাকিন আলী। তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করলে টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। তখন দৌড়ে যেতে হয় বাড়ি। এজন্য কোনো সমস্যা হলে দোকান থেকে ওষুধ কিনে দেন তিনি। এতে অসুখ ভালো না হওয়ায় পরে হাসপাতালে যেতে হয়।
কমিউনিটি ক্লিনিকে নারীরা বেশি সেবা নিতে আসেন জানিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চারঘাট শাখার সহসভাপতি আঞ্জুমনোয়ারা ময়না বলেন, মাতৃসেবাসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা ও ওষুধ নেন তারা। অথচ শৌচাগার নির্মাণের নামে লুটপাট হয়েছে। নির্মাণের সময় তাদের মতের গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। প্রয়োজনে বরাদ্দ বাড়িয়ে পর্যায়ক্রমে সব কাজ করা যেত। নিম্নমানের নির্মাণের কারণে এখন সব অকেজো। লোক দেখানো প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কোটি টাকা পানিতে ফেলা হয়েছে।
চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌফিক রেজা বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকে ৩০ ধরনের ওষুধ থাকে। গ্রামীণ রোগীদের যারা উপজেলা সদরে আসতে পারেন না, তারা এখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা ও ওষুধ নেন। রোগী ও তাদের স্বজনদের জন্য শৌচাগার গুরুত্বপূর্ণ। নতুন শৌচাগারগুলো ব্যবহার করা যাচ্ছে না। পরবর্তী সভায় বিষয়টি নিয়ে সিএইচসিপিদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চারঘাটের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. ফরহাদ লতিফ ও বাঘার মো. মাহমুদুল ইসলামের ভাষ্য, কাজগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে কোন ক্লিনিকে কী কারণে ব্যবহার করা যাচ্ছে না, এ বিষয়ে ক্লিনিকগুলো জানালে মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

×