ফসল আবাদ বন্ধ, জলাবদ্ধতায় অসহায় পাগনাপারের কৃষক
পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ থাকায় জলমগ্ন সুনামগঞ্জের পাগনার হাওরপারের লক্ষ্মীপুর গ্রামের পশ্চিমাংশ সমকাল
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৩:৪২
অপরিকল্পিত খনন কাজের কারণে প্রায় চার কোটি টাকা গচ্চা গেলেও দুর্ভোগ কমেনি জামালগঞ্জের পাগনার হাওরপারের বাসিন্দাদের। এ এলাকার ১৫ হাজার কৃষক প্রায় তিন হাজার হেক্টর জমিতে ফসল আবাদ করতে পারেননি জলাবদ্ধতার কারণে।
পাগনাপারের বাসিন্দারা জানান, জলাবদ্ধতার সংকট দূর করার নামে এর আগে প্রায় চার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ করা হয়েছে এখানে। তবে কাজের ধরন দেখে বোঝা গেছে, প্রকল্পের নামে অর্থ লোপাটই ছিল সংশ্লিষ্টদের মূল লক্ষ্য। অপরিকল্পিত খনন কাজ এবং লুটপাটের কারণে এসব প্রকল্প সাফল্যের মুখ দেখেনি। দুঃখ ঘোচাতে পারেনি পাগনাপারবাসীর। এখন স্থানীয় গরিব কৃষকরা চাঁদা তুলে পানি নিষ্কাশনের মাধ্যমে অস্থায়ীভাবে এ সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
জানা যায়, সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের ভীমখালী ও ফেনারবাক ইউনিয়নের বিশাল এলাকা নিয়ে পাগনার হাওরের অবস্থান। এ হাওরপারের ৪০ গ্রামের মানুষ প্রায় দশ বছর ধরে জলাবদ্ধতার কষ্টে ভুগছেন। গত দশ বছর কর্তৃপক্ষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে হাওরের পানি নিষ্কাশনের জন্য কানাইখালী নদী খনন প্রকল্পের কাজ আদায় করা হয়। তবে বাস্তবে অপ্রকল্পের নামে চলেছে হরিলুট। অপরিকল্পিতভাবে খননের কাজ করায় অর্থ ব্যয় হলেও কৃষকের ভাগ্য ফেরেনি। কৃষকরা জানান, প্রতি মৌসুমে চাঁদা তুলে পানি নিষ্কাশনের অস্থায়ী ব্যবস্থা করেন তারা। এবারও একই পরিস্থিতি দেখে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে স্থানীয়দের। এ নিয়ে উৎকণ্ঠায় আছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, কৃষক, রাজনীতিক ও সচেতন মহলসহ সবাই। এরই মধ্যে জেলার অন্যান্য হাওর এলাকায় চাষাবাদ শুরু হলেও এই হাওরের পানি নিষ্কাশন নিয়ে এখনও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষক।
স্থানীয় কৃষক নেতা ও জেলা জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতা সিরাজুল হক অলি জানান, হাওররক্ষা বাঁধের জন্য কোটি কোটি টাকার প্রকল্প হচ্ছে; অথচ হাওরে ফসল আবাদের চেষ্টা হচ্ছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সংশোধিত কাবিটা নীতিমালার স্কিম নির্বাচনের ৩-এর ৪ বিধিতে উল্লেখ আছে, উপকারভোগীদের প্রয়োজনে পানি নিষ্কাশন প্রকল্প নেওয়া যাবে।
পাগনার হাওর এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন পাউবো প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, জলাবদ্ধতার জন্য চাষাবাদ না হলে বাঁধের কোনো প্রয়োজন নেই। তবে স্থানীয়দের ক্ষোভ এড়িয়ে গেছেন সংশ্লিষ্টরা।
কর্তৃপক্ষ জানায়, কানাইখালী নদীর ভূতিয়ারপুরের গুদারাঘাট থেকে পাগনার হাওরের লম্বাবিল পর্যন্ত যে খাল খনন হয়েছে, তাতে ৫০ ভাগের বেশি কাজ হয়নি। এই খাল দিয়ে নয়, মৌজার পানি এসে পাগনা বিলে জমা হয়। ওখান থেকে গজারিয়া স্লুইস গেট ও ডালিয়া স্লুইস গেট দিয়ে পানি সুরমা নদীতে নামে না। এ অংশ স্থানে স্থানে ভরাট হয়ে গেছে। বিশেষ করে স্লুইস গেট অংশ ভরাট হওয়ায় ওপরের পানি নিচের দিকে নামলেও জলাবদ্ধতা থেকেই যায়।
গঙ্গাধরপুরের বাসিন্দা জিতেন্দ্র তালুকদার পিন্টু জানান, কানাইখালী নদী খননের জন্য অর্থ ব্যয় হলেও অপরিকল্পিত ব্যয় হয়েছে ওখানে। মিনি ড্রেজার দিয়ে খনন করা মাটি দূরে ফেলার জন্য দরপত্রে উল্লেখ ছিল। খনন করা হয়েছে এক্সক্যাভেটর দিয়ে। খালের মাটি পাড়ে তুলে রাখা হয়েছে। বর্ষায় সেই মাটি আবার খালে ধুয়ে এসে ভরাট হয়েছে খাল। এখন চাষাবাদের মৌসুম। অথচ পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় গ্রামের কৃষকরা জমিতে ফসল বুনতে পারছেন না।
জানা যায়, কানাইখালী নদী খননের কাজ করেছেন নেত্রকোনার প্রভাবশালী এক আওয়ামী লীগ নেতার ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার। এলাকার মানুষ প্রকল্পের অপরিকল্পিত কাজে সে সময় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও ঠিকাদার তা পাত্তা দেননি।
সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আজাদ হোসেন বাবলু জানান, প্রতি বছর পানি নিষ্কাশন কাজের জন্য বরাদ্দ এলেও পরিকল্পিতভাবে কাজ না করায় এ অর্থ জলে গেছে। খালপাড়ে রাখা মাটিতেই খাল ভরাট হয়ে গেছে। এতে প্রতিবারই একইভাবে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কাজল বরণ তালুকদার তাদের জানিয়েছেন, পাউবোসহ বিভিন্ন স্থানে ধরনা দিয়েও কাজ হয়নি।
ফেনারবাক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কাজল বরণ তালুকদার জানান, লামাপাগনা অংশ হচ্ছে পাগনার হাওরের পানি নামার খাল গজারিয়া ও ঢালিয়ার উৎসমুখ। এ অংশে মাটি ভরাট হয়ে পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গজারিয়া খালের স্লুইস গেট বর্ষায় খুলে দেওয়ায় ওখানে পলি ভরাট হয়েছে। ঢালিয়া খনন না হওয়ায় পানি কম নামছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে প্রায় ৫০ লাখ টাকার দুটি প্রকল্প গেল বছর হয়েছিল খাল খননের জন্য, খাল খননও হয়েছিল। পলিতে খালের উৎসমুখ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বিপত্তি দেখা দিয়েছে।
তিনি জানান, কানাইখালী নদীর চার কিলোমিটার গেল অর্থবছরে চার কোটি টাকা ব্যয়ে খনন করা হলেও কোনো লাভ হয়নি। এই নদীর ভেতরের অংশে কিছু খননের কাজ হয়েছে। সেলিমগঞ্জ থেকে সুরমা নদী পর্যন্ত খনন না হওয়ায় এটিও অকার্যকর হয়ে আছে। পরিকল্পিতভাবে কাজ করা হলে সর্বোচ্চ দুই কোটি টাকা ব্যয় হতো।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান, গেল বছর পাগনার হাওরের পানি নিষ্কাশনের জন্য হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও মনিটরিং কমিটির পক্ষ থেকে দুটি প্রকল্প দিয়ে প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের কাজ করা হয়েছে। এই খালের পলি ভরাট ঠেকাতে হলে স্লুইস গেটের আগে পলি আটকানোর জন্য গভীর গর্ত রাখতে হবে। তবে এখানে নদী কাছাকাছি থাকায় এটিও সম্ভব হবে না। আপাতত বছর বছর সংস্কার করা ছাড়া উপায় নেই। এ সময় কানাইখালী নদীতে অপরিকল্পিত খনন কাজ এবং ড্রেজারের পরিবর্তে এক্সক্যাভেটর দিয়ে কাজ করার ব্যাপারে জানতে চাইলে তা এড়িয়ে যান ওই কর্মকর্তা।
- বিষয় :
- পানি