ঢাকা রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

স্বপ্ন ভেঙে হতাশ সাকিব চেয়েছিলেন ঘুরে দাঁড়াতে

স্বপ্ন ভেঙে হতাশ সাকিব চেয়েছিলেন ঘুরে দাঁড়াতে

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দােলনে নিহত সাকিবের শোক এখনও কাটেনি পরিবারের সদস্যদের। রাজশাহী নগরীর আলুপট্টি মোড়ের বাসায় সমকাল

সৌরভ হাবিব, রাজশাহী

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ০০:১৩

চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ছিল সাকিব আনজুমের। কিন্তু সরকারি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাননি। আর বেসরকারি মেডিকেলে সুযোগ পেলেও টাকার অভাবে পড়া হয়নি। এই কষ্টে দীর্ঘদিন বন্ধ রাখেন পড়াশোনা। পরে ভর্তি হন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। অনার্স শেষের আগে থেকে ফিনল্যান্ডে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সাকিব। কিন্তু গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। 

রাজশাহী নগরীর আলুপট্টি এলাকার মায়নুল হক ও রোকেয়া খাতুন দম্পতির বড় ছেলে সাকিব। উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর মেডিকেলে পড়ার স্বপ্ন ভাঙায় তিনি চরম হতাশ হন। পরে তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা দেখে খুশি হয়েছিলেন মা-বাবা। কিন্তু এখন ছেলেকে হারিয়ে তারা শোকে যেন পাথর হয়ে গেছেন। আর সাকিবকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন স্ত্রী নিশাত সালসাবিল।
রাজশাহীর বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন সাকিব। তাঁর নিহত হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক সালাউদ্দীন আম্মার বলেন, ‘৫ আগস্ট নগরীর শাহ মখদুম কলেজ এলাকায় মিছিলের প্রথম সারিতে ছিলেন সাকিব ভাই। আমাদের সামনে ছিল সশস্ত্র আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও পুলিশ। তারা মিছিলে ককটেল ও গুলি ছুড়ছিল। এক পর্যায়ে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। মেয়েদের নিরাপত্তার টিমে কাজ করছিলেন সাকিব ভাই। ছত্রভঙ্গ হয়ে মেয়েরা একটি গলির ভেতর যায়। সেখানে খুব কাছ থেকে সাকিব ভাইকে গুলি করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। মেয়েরা তাঁকে উদ্ধার করে একটি বাড়িতে রাখে। এ সময় আওয়ামী ক্যাডাররা ডাবলু সরকারের (মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) নেতৃত্বে বাড়িটি ঘেরাও করে। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর সেখানে সাকিব ভাইয়ের মৃত্যু হয়।’

এই ঘটনায় ২৩ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, ডাবলু সরকারসহ ৪২ জনের নামে বোয়ালিয়া মডেল থানায় মামলা করেন সাকিবের বাবা মায়নুল হক। পরে ডাবলুকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। ৫ আগস্ট পুলিশ ও চিকিৎসক না পাওয়ায় সাকিবের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়েছিল। এ কারণে সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে দাফনের ৭২ দিন পর মরদেহ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্ত করা হয়।
তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় সাকিব ২০১৬ সালে এসএসসি এবং ২০১৮ সালে এইচএসসি পাস করেন জিপিএ ৫ নিয়ে। ওই বছর মেডিকেল কলেজে ভর্তির পরীক্ষা দেন। কিন্তু চান্স না পাওয়ায় ভেঙে পড়েন। ছেলের সেদিনের কথা মনে করে রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘হাসিমুখে বাড়ি ফিরে সাকিব বলেছিল, পরীক্ষা খুবই ভালো হয়েছে মা।’ কিন্তু সেদিন বিকেলেই কাঁদতে কাঁদতে বাইরে থেকে বাসায় ফিরে বলে, ‘প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। পানের দোকানেও প্রশ্ন পাওয়া যাচ্ছে। আমার আর চান্স হবে না মা।’ রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘সরকারি মেডিকেলে সত্যিই তার চান্স হলো না। একটি বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেল। কিন্তু আর্থিক সংকটে তাকে আমরা পড়াতে পারলাম না। এতে সে খুব কষ্ট পেয়েছিল।’

ছেলের সেই কষ্টের কথা মনে করে রোকেয়ার চোখে পানি চলে আসে। আঁচলে চোখ মুছে তিনি বলেন, ‘এরপর দীর্ঘদিন পড়াশোনা বন্ধ। এক পর্যায়ে জোর করেই সাকিবকে বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিই। পড়াশোনার ফাঁকে ফিনল্যান্ডে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু সে পৃথিবী থেকেই চলে গেল।’ 
২০১৫ সালে এক বান্ধবীর মাধ্যমে সাকিবের সঙ্গে পরিচয় হয় নিশাত সালসাবিলের। এর পর ২০১৮ সালে এইচএসসি পাস করে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন তারা। তবে সংসার শুরু করেন বছর দেড়েক আগে। নিশাত বলেন, ‘সাকিব শুধু আমার স্বামী ছিল না, একমাত্র বন্ধুও ছিল। তার চলে যাওয়ায় আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি।’
সরকারের কোনো আর্থিক অনুদান পায়নি সাকিবের পরিবার। এ নিয়ে অবশ্য মায়নুল হক ও রোকেয়া খাতুনের আক্ষেপ নেই। তারা চান বিচার। 
মায়নুল হক বলেন, ‘প্রশাসনের মাথায় এখনও ফ্যাসিবাদের দোসররা বসে আছে। তাই বিচার পাব কিনা সন্দেহ আছে।’
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের উন্নত চিকিৎসার দাবি জানিয়ে রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘আমার ছেলেকে তো হারিয়েই ফেলেছি। কিন্তু আর কেউ যেন সন্তানকে না হারায়। তাই যারা আহত হয়েছে, তাদের দ্রুত উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে আমার সন্তান জীবন দিয়ে যে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, তা সফল হবে না।’ 

আরও পড়ুন

×