জীবন বাঁচানো চাকরিটাই কেড়ে নিল শুক্লার প্রাণ
কিস্তি আদায় করতে না পারার অভিযোগ তুলে কাটা হতো বেতন, করা হয় বদলিও

শুক্লা দে টিকলি
সারোয়ার সুমন ও শাহীনুর কিবরিয়া মাসুদ, বোয়ালখালী থেকে
প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ | ০১:৫৯ | আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ | ১১:১২
চাকরিতে বেতন নগণ্য, তার মধ্যে পরিবারে সদস্য চারজন। স্বামীর আয়ের পথ বন্ধ হওয়ায় একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন শুক্লা দে টিকলিই। পারিবারিক দুর্দশা তাই সবসময় মাথায় ঘুরত তাঁর, করতেন হাড়ভাঙা পরিশ্রম। তার পরও শান্তি ছিল না মনে। কর্মক্ষেত্রের নানা মানসিক চাপ মুখ বুজে সয়ে শুধু টিকে থাকতে চেয়েছিলেন জীবনযুদ্ধে। তবে উপর্যুপরি চাপ আর বেশি দিন নিতে পারেননি তিনি; চাকরি এবং জীবন– এই দুই জটিল অঙ্কের হিসাব কষা থেকেই নিয়েছেন চিরদিনের ছুটি।
গত শনিবার রাতে নিজ বাড়ি থেকে ৩৮ বছর বয়সী শুক্লার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। অফিসের ঊর্ধ্বতনদের মানসিক নির্যাতন এবং অন্যায্য চাপ সইতে না পেরে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পরিবারের।
শুক্লার বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নের পালপাড়ায়। আজ তাঁর আদ্যশ্রাদ্ধ। গতকাল সোমবার দুপুরে বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায় শুক্লার ছেলে ঋত্বিক পালকে। পুরোহিতের সঙ্গে মন্ত্রপাঠ করছিলেন তিনি। একটু দূরে ছিলেন মেয়ে রক্তিমা পাল, বসেছিলেন আনমনে। সঙ্গে ছিলেন শুক্লার ছোট ভাই অনুপম দে বাবু। সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই তিনি বললেন, ‘বোনের এই চাকরিটা দিয়েই চলছিল সংসার।
বড় ছেলে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। মেয়ে পড়ে নবম শ্রেণিতে। কিন্তু কর্মহীন ছিল তার স্বামী। যে চাকরি দিয়ে এত মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে শুক্লা; রূপসা সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতির সেই চাকরিটাই কেড়ে নিল তার প্রাণ। দুই মাস ধরে সেই অফিসের কর্মকর্তাদের অমানুষিক নির্যাতন সইতে না পেরে বোন ফাঁস দিল।’
রূপসা সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি কানুনগোপাড়া অফিসের ফিল্ড অফিসার হিসেবে ২০২৩ সালের মে মাসে যোগ দেন শুক্লা। মাসে বেতন পেতেন ১৫ হাজার টাকা। তাঁর কাজ ছিল গ্রাহকদের ঋণ বিতরণ ও কিস্তি আদায়।
আত্মহত্যার কয়েক ঘণ্টা আগে বড় জা রুনু পালের সঙ্গে ভাত খেয়েছিলেন শুক্লা। তিনি বলেন, কয়েক মাস ধরে অনেক গ্রাহকের আর্থিক অবস্থা খারাপ যাচ্ছিল। কিস্তির টাকা তুলতে বেকায়দায় পড়েন শুক্লা। তবে অফিস এটা মানতে পারেনি। নানাভাবে মানসিক চাপ দিতে থাকে তাঁকে, করা হতো দুর্ব্যবহার। বেতনও কাটা হয়। অবশেষে নভেম্বরে তাঁকে বদলি করা হয়। সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত ছিলেন শুক্লা।
তাঁর স্বামী সিদুল পাল বলেন, একটা ডেভেলপার কোম্পানিতে চাকরি করতাম। প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক সংকটে পড়ায় কয়েক মাস আগে চাকরি চলে যায়। শুক্লার চাকরি দিয়েই চলছিল সংসার। কিন্তু দুই মাস ধরে অফিসের নানা বিষয় নিয়ে সে খুব দুশ্চিন্তা করত।
আটকে রাখা হয়েছিল শুক্লাকে
উপজেলার আমুচিয়া কানুর দিঘিরপাড় এলাকায় গত বছর ১৯ অক্টোবর কিস্তি আদায় করতে গিয়ে ফাঁদে পড়েন শুক্লা। যারা কিস্তির টাকা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, তারা তাঁর বিরুদ্ধে আত্মসাতের অভিযোগ তোলেন। দিনভর তাঁকে আটকে রেখে সন্ধ্যায় নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। এ নিয়ে গত ২৪ নভেম্বর শুক্লা বোয়ালখালী থানায় ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু এটির কোনো সুরাহা হয়নি। অথচ তিনি অক্টোবরের ঘটনার জন্য ঋণদান কেন্দ্রের সভাপতি কুমকুম বেগমসহ চারজনকে অভিযুক্ত করেছিলেন। পরে সেই অভিযোগ স্থানীয়ভাবে মীমাংসা করা হয়। এতে দু’পক্ষের আলোচনায় ৪ লাখ ১৬ হাজার টাকা গরমিল হওয়ার বিষয় উঠে আসে। শুক্লাকে ২ লাখ ৮ হাজার টাকা এবং অবশিষ্ট টাকা রূপসা সার্বিক সমবায় সমিতিকে পরিশোধ করার সিদ্ধান্ত দেয় স্থানীয়রা। ধাপে ধাপে এই টাকা দিতে বলা হলেও শুক্লার অফিস সব টাকা এককালীন পরিশোধের চাপ দিতে থাকে। হঠাৎ ১৬ কিলোমিটার দূরে পটিয়া উপজেলার ধলঘাট অফিসে বদলি করে দেওয়া হয়। শুক্লার মাসিক বেতন থেকেও টাকা কেটে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
অভিযোগ প্রসঙ্গে কুমকুম বেগমকে ফোন দেওয়া হলে ধরেন তাঁর স্বামী। কুমকুম ব্যস্ত আছেন বলে এড়িয়ে যান তিনি।
নানা অভিযোগ সমিতির বিরুদ্ধে
রূপসা সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতির বিরুদ্ধে আছে নানা অভিযোগ। কিস্তি দিতে না পারলে গ্রাহকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে তারা। আবার কিস্তির টাকা উঠাতে না পারলে ফিল্ড অফিসারদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করা হয়। গতকাল দুপুরে এই সমিতির কানুনগোপাড়া অফিসে গিয়ে জানা যায়, সংস্থাটি বোয়ালখালীর উপজেলা সমবায় অফিসে ২০২৩ সালের নিবন্ধনপ্রাপ্ত। এ অফিসের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন কাঞ্চন দেবনাথ। সেখানে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। কাঞ্চন দেবনাথ গত শনিবার থেকে ছুটিতে রয়েছেন বলে জানান ফিল্ড অফিসার জয় দে। তিনি বলেন, ‘শুক্লা দি চমৎকার মনের মানুষ ছিলেন। সত্যি কথা বলতে কী, দিদিকে গ্রাহকরা ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। দিদির বিষয়ে অফিস তেমন একটা অনিয়ম পায়নি।’
এ সংস্থার আরেকটি অফিস পটিয়ায়। এ উপজেলায় ২০১৯ সালে সংস্থাটি নিবন্ধন পায়। একই নামে দুই উপজেলায় সংস্থাটি পরিচালনা করছেন কাঞ্চন দেবনাথ ও পলাশ দেবনাথ।
যা বললেন শীর্ষ কর্মকর্তা
সংস্থাটির ম্যানেজার কাঞ্চন দেবনাথ দাবি করেন, শুক্লার সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয়নি। অহেতুক তাদের জড়িয়ে প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। হয়তো পারিবারিক কোনো কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
শুক্লার স্বামীর করা মামলায় চার আসামি হলেন– রূপসা সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতির কানুনগোপাড়া শাখার ম্যানেজার কাঞ্চন দেবনাথ, পটিয়া শাখার ব্যবস্থাপক পলাশ নাথ এবং নন্দন ও ছিনু বিশ্বাস।
- বিষয় :
- আত্মহত্যা