ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

‘পুরোনো শত্রু’ খুলনায়, খুন কক্সবাজারে!

‘পুরোনো শত্রু’ খুলনায়, খুন কক্সবাজারে!

খুলনা নগরীর দৌলতপুর এলাকার সাবেক কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপু।

খুলনা ব্যুরো ও কক্সবাজার প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৮:৫৭ | আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫ | ২১:০০

পুরোনো শত্রুরাই নিজস্ব ছকে খুলনা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপুকে গুলি করে হত্যা করেছে। টিপুর পরিবারের ধারণা, স্থানীয় শত্রুতার জের ধরে খুলনার সন্ত্রাসীরাই কক্সবাজারে গিয়ে টিপুকে মেরে ফেলেছে। কক্সবাজারের কোনো লোকের সঙ্গে টিপুর বিরোধ ছিল না। খুলনার কেউ কক্সবাজারে ভাড়াটে খুনি দিয়ে তাঁকে হত্যা করিয়েছে। 

এদিকে কক্সবাজারে টিপু হত্যার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দু’জনকে হেফাজতে নিয়েছে র্যা ব। তারা হলেন খুলনা ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ হাসান ইফতেখার এবং কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ার বাসিন্দা মেজবাহ উল্লাহ ভুট্টো।  হত্যার ঘটনায় টিপুর ভগ্নিপতি ইউনুস আলী শেখ বাদী হয়ে মামলা করলেও শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। মামলায় সুনির্দিষ্ট কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। সব আসামিকে দেখানো হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয়। টিপু ও ইফতেখারের সঙ্গে একই আবাসিক হোটেলে থাকা তরুণী রুমি ঘটনার পরই পালিয়েছেন। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে টিপুর লাশ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

খুলনার সন্ত্রাসীদের হাতেই খুন! 
গতকাল সকালে খুলনার দৌলতপুরের দেয়ানা উত্তরপাড়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় লোকজন সেখানে ভিড় করেছেন। সন্তানের শোকে বারবার জ্ঞান হারান বাবা গোলাম আকবর। কান্নায় ভেঙে পড়েন টিপুর ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের সদস্যরা। 

টিপুর বড় ভাই গোলাম রসুল বাদশা জানান, বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজার থেকে একজন ফোন করে তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুর খবর জানান। রাতেই পরিবারের সদস্যরা কক্সবাজারের উদ্দশে রওনা দেন। তিনি বলেন, খুলনার শত্রুরাই টিপুকে কৌশলে কক্সবাজারে নিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

নগরীর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শেখ শামসুদ্দিন আহম্মেদ প্রিন্স বলেন, টিপু এলাকায় জনপ্রিয় কাউন্সিলর ছিলেন। এ ঘটনায় আমরা বিস্মিত। 

টিপুর পরিবারের সদস্যরা জানান, পুলিশের কাছ থেকে লাশ বুঝে নিয়ে গতকাল রাতে খুলনার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন স্বজনরা। আজ শনিবার জোহরের নামাজের পর দৌলতপুরের দেয়ানা উত্তরপাড়া মাঠে টিপুর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। পরে সরকারপাড়া কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হবে।

টিপুদের আদি বাড়ি খুলনার তেরখাদা উপজেলার আনন্দনগর গ্রামে। তাঁর বাবা গোলাম আকবর দৌলতপুর মহসীন বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে টিপু ছিলেন ছোট। 

স্থানীয় লোকজন জানান, ছাত্রজীবনে টিপু ছাত্র মৈত্রীর রাজনীতি করতেন। পরে চরমপন্থি দলে সম্পৃক্ত হন। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যোগ দেন স্বেচ্ছাসেবক লীগে। 

২০২৩ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত খুলনা সিটি নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এর আগে ২০১৮ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়ে হারেন। 

২০১৫ সালের ৩০ অক্টোবর দৌলতপুরে খুন হন নিষিদ্ধ সংগঠন বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি নেতা শেখ শহীদুল ইসলাম ওরফে হুজি শহীদ। ওই হত্যা মামলায় টিপুকে প্রধান আসামি করা হয়। 

স্থানীয় বিএনপি জামায়াত নেতারা জানান, কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই এলাকার সবার সঙ্গে টিপুর সুসম্পর্ক ছিল। পুলিশের হয়রানি থেকে অনেককেই বাঁচিয়েছেন তিনি। গত ৫ আগস্টের পর কয়েকদিন গা-ঢাকা দিলেও পরে এলাকায় ফেরেন। অপসারিত হওয়ার আগ পর্যন্ত নিয়মিত তিনি নগর ভবনে যেতেন।

খুলনার দৌলতপুর থানার ওসি মীর আতাহার আলী বলেন, টিপুর বিরুদ্ধে দৌলতপুরে থানায় দুটি মামলা রয়েছে। দুটিতেই তিনি জামিনে ছিলেন। হত্যার বিষয়ে আমরাও খোঁজখবর নিচ্ছি। 

যেভাবে খুন হন টিপু
কক্সবাজারের কলাতলীর হোটেল গোল্ডেন হিলে গত বৃহস্পতিবার সকালে উঠেছিলেন গোলাম রব্বানী টিপু, শেখ হাসান ইফতেখার ও তরুণী রুমি। হোটেলটির ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শফিক জানান, হোটেলটির দুই কক্ষের ৭০৩ নম্বর ফ্ল্যাটে ওঠেন তারা। সন্ধ্যার পর ওই তরুণীকে নিয়ে টিপু হোটেল থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি।

হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, সন্ধ্যা ৬টা ৩১ মিনিটে ওই তরুণীসহ টিপু হোটেল থেকে বেরিয়ে যান। এর পর রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে সৈকতসংলগ্ন হোটেল সিগালের সামনের ফুটপাতে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন টিপু। 

টিপুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া অটোরিকশা চালক আব্দুস সালাম বাবু বলেন, ‘সিগাল হোটেলের সামনে একটি গুলির শব্দ শুনতে পাই। তখন দেখি এক ব্যক্তি ঢলে পড়েছেন। পরে ওই গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে উদ্ধার করে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাই। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।’

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ৮টার দিকে টিপু সিগাল হোটেলের সামনে ঝাউবাগানের ভেতরে কাঠের তৈরি সেতুর পাশে হাঁটছিলেন। এ সময় মোটরসাইকেলে দুই ব্যক্তি এসে টিপুর মাথায় গুলি করে পালিয়ে যায়। 

কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি ইলিয়াছ খান বলেন, খুলনা পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে টিপু আত্মগোপনে ছিলেন। কেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, টিপু হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে মাঠে নেমেছে পুলিশ।

আরও পড়ুন

×