ঢাকা শনিবার, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫

হাসপাতালে দুই কোটি টাকার কেনাকাটায় ঘাপলা

হাসপাতালে দুই কোটি টাকার কেনাকাটায় ঘাপলা

.

 ঝিনাইদহ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৫ | ০১:১৩ | আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৫ | ০৭:৪৪

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে গত অর্থবছরে কেনাকাটায় প্রায় দুই কোটি টাকার অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অডিট (নিরীক্ষা) দল। এ নিয়ে তারা আপত্তি প্রতিবেদন দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ডা. সৈয়দ রেজাউল ইসলাম এর সঙ্গে জড়িত।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালের বার্ষিক বরাদ্দ থেকে ৬৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে হয় ওষুধ কেনার জন্য। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ টাকা দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) থেকে ওষুধ কিনতে হয়। বাকি ৩০ শতাংশ অর্থ দিয়ে দরপত্রের মাধ্যমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ঠিকাদারের সাহায্যে ওষুধ কিনতে হয়।

কিন্তু ২০২৪ সালের ১৪ থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অডিট আপত্তি প্রতিবেদনে ২ কোটি ৯ লাখ ৫৩ হাজার ৯৯৮ টাকার অনিয়মের তথ্য মিলেছে। এর মধ্যে ভোগ্যপণ্য কেনায় ৪৪ লাখ ৩১ হাজার ১৬০ টাকা এবং হারমাইন এন্টারপ্রাইজ থেকে ফার্নিচার কেনায় সর্বনিম্ন ভ্যাট কাটায় সরকার রাজস্ব হারায় ১ লাখ ৪৭ হাজার ১৫০ টাকা।

অর্থবছরের শেষ ধাপে বরাদ্দ ৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকার ওপরে এই অডিট হয়। যেখানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক নিয়ম না মেনে ৯১.৯২ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান প্যারাগন এন্টারপ্রাইজ থেকে ওষুধ কিনে।

হাসপাতাল সূত্রে আরও জানা যায়, একই অর্থবছরে রাজস্ব খাতের বরাদ্দে ৪ কোটি ৯৩ লাখ ৯১ হাজার ১৬ টাকার ওষুধ ইডিসিএল থেকে এবং দরপত্রের মাধ্যমে বেসরকারিভাবে ৩ কোটি ২৯ লাখ ২৭ হাজার ২৪৪ টাকার ওষুধ কেনা হয়। এই ওষুধও প্যারাগন এন্টারপ্রাইজ থেকে কেনা হয়েছিল।

এই অর্থবছরে উন্নয়ন খাতে আরও একটি বরাদ্দ ছিল ৩ কোটি টাকা, যার ২ কোটি ৭৯ লাখ ৯৯ হাজার ৮৫১ টাকার ওষুধ কেনা হয় ঠিকাদারের মাধ্যমে।

হাসপাতালসংশ্লিষ্টরা জানান, ডা. সৈয়দ রেজাউল ইসলাম ২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে ঝিনাইদহ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে যোগ দেন। ওই বছরই লিনেন সামগ্রী (গজ, ব্যান্ডেজ, তুলাসহ অন্যান্য) কেনার একটা দরপত্র হয়। এর বরাদ্দ ছিল প্রায় ৪৮ লাখ টাকা। এই টাকায় ঢাকার একটি পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে মালপত্র কেনেন রেজাউল।

২০২২-২৩ অর্থবছরে বরাদ্দ আসে ১১ কোটি ৪৫ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। এখানেও নিয়মের বাইরে গিয়ে দরপত্রের মাধ্যমে কেনা হয় ৭ কোটি ২ লাখ ৮৪ হাজার ৬৬০ টাকার ওষুধ। এই বছরে রাজস্ব খাতে বরাদ্দ ছিল ৫ কোটি ৯৮ লাখ ৬৮ হাজার ২৫০ টাকা। এখানে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৯৩ হাজার ৮৮০ টাকার ওষুধ কেনা হয় দরপত্রের মাধ্যমে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করে দরপত্র কারসাজির মাধ্যমে পছন্দমতো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে ওষুধ কেনাতেন। কখনও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি টাকায় ওষুধ কেনা, আবার কখনও ভ্যাট কম দেখানো হতো। নানাভাবে হিসাবরক্ষকের সহযোগিতায় অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ছিল রেজাউলের বিরুদ্ধে।

তাঁর যোগ দেওয়ার প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত হিসাবরক্ষক ছিলেন ফেরদৌস হাসান। সে সময় একটি দরপত্রের কাজ না পাওয়ায় ফেরদৌসকে লাঞ্ছিত করেন যুবলীগ নেতা বাসের আলম সিদ্দিকী। এরপর দরপত্র দেওয়ার পেছনে হিসাবরক্ষককে দায়ী করে মহেশপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক।

সোহেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল রেজাউল ইসলামের। তিনি রেজাউলের পুরোটা সময় হিসাবরক্ষক হয়ে কাটিয়েছেন। অভিযোগ ছিল, সর্বনিম্ন দরদাতার তথ্য ফাঁস করে নেতাদের ম্যানেজ করে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতেন। কারণ হাসপাতালে কোনো দরপত্র হলে হিসাব থাকত তত্ত্বাবধায়ক ও হিসাবরক্ষকের কাছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সোহেল ফরাজীকে অন্যত্র বদলি করা হয়, অনিয়মের অভিযোগে শিক্ষার্থীদের চাপে কর্মস্থল ছাড়তে বাধ্য হন রেজাউলও।

এ বিষয়ে ফেরদৌস হাসান বলেন, ‘নিয়মের বাইরে কাজ করিনি। তত্ত্বাবধায়ক পছন্দমতো কাজ করে আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছিলেন।’

সোহেল ফরাজী বলেন, ‘হিসাবরক্ষক হিসেবে আমার কাজ ছিল ফাইলপত্র গুছিয়ে রাখা। অন্য কোনো কাজ ছিল না। শুধু বিলের টপ শিটে সই থাকত। তবে সব কাজ তত্ত্বাবধায়কের সইয়ে হতো।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সৈয়দ রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘কোনো অনিয়ম হয়নি। প্রচুর চাহিদা ছিল এবং ইডিসিএল ওষুধ দিতে অনাপত্তিপত্র দেওয়ায় ঠিকাদারের মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকার ওষুধ কেনা হয়েছিল। অডিটের উত্তর আমার মতো করে দেব।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটা দরপত্রে জেলা প্রশাসন, প্রকৌশলী, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন দপ্তরের সাতজন সদস্য থাকে। সুবিধা নেয় সবাই। কিন্তু দায় চাপায় তত্ত্বাবধায়কের ওপর। বিস্তারিত আর বলব না।’

স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা দলের সদস্য (এসএএস সুপার পদমর্যাদার) শাহেদুর রহমান বলেন, ‘অডিট হয়েছে, কিছু আপত্তি মিলেছে।’
বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আগের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিল/ভাউচার যাচাই করে নিয়মানুযায়ী ভ্যাট কাটা হবে।

আরও পড়ুন

×