সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্তের পর্যটন কেন্দ্র সারী নদী
জৈন্তাপুরে লালাখাল খুবলে ‘খাচ্ছে’ সর্বদলীয় চক্র
আ’লীগ, বিএনপি, জামায়াত নেতাকর্মী গড়ে তুলেছে চক্র

সিলেটের জৈন্তাপুরে নীল নদখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র লালাখাল থেকে এভাবেই অবৈধভাবে তোলা হচ্ছে বালু। সম্প্রতি তোলা - ইউসুফ আলী
মুকিত রহমানী, সিলেট
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৫ | ০১:১৪
ভারতের চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে সারী নদী। এর উৎসমুখের নাম লালাখাল। নীল জলের জন্য এই খালের খ্যাতি। এ কারণে স্থানীয়রা একে ‘নীল নদ’ বলে ডাকে। এই নদী খুবলে অবৈধভাবে বালু তুলছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মী।
নীল পানির ঘোলাটে রং
গত বৃহস্পতিবার লালাখাল জিরো পয়েন্ট এলাকায় সরেজমিন দেখা গেছে, লালাখালের উৎসমুখে শতাধিক ইঞ্জিনচালিত নৌকার জট। যেন নৌকার হাট। বাস্তব চিত্র ভিন্ন। নৌকাগুলো বালু তোলার জন্য জড়ো করা হয়েছে। কার আগে কে নৌকা ভর্তি করবে, তা নিয়ে শ্রমিকদের চলছে প্রতিযোগিতা। আরেক পক্ষ ডাঙায় দাঁড়িয়ে সংগ্রহ করছে বালুর বিপরীতে চাঁদা। নদীর এক পাড়ে কয়েকজন সীমান্তরক্ষীর (বিজিবি) অবস্থান। কয়েকশ গজ দূরে রয়েছে বিজিবি ফাঁড়ি। শ্রমিকরা নদীর বুক থেকে বাধাহীনভাবে তুলছে বালু। কেউ বালুভর্তি নৌকা নিয়ে ছুটছে; কেউবা নৌকা ভেড়াচ্ছে।
সরেজমিন আরেও দেখা গেছে, বালু তোলায় নদীর নীল পানি ঘোলাটে রং ধারণ করেছে। লালাখাল পর্যটন ঘাট থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত দেড় কিলোমিটারজুড়ে পানির অধিকাংশ রং পাল্টে গেছে। একই অবস্থা সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের পাশ থেকে শুরু হওয়া সারী ঘাট-জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটারজুড়ে। ফলে সারী নদীতে কমেছে পর্যটকের সংখ্যা। মূলত নীল পানির নদীতে ভ্রমণের জন্য পর্যটকরা আসেন।
রুবেল নামে স্থানীয় এক নৌকার মাঝি জানান, বালু তোলা বন্ধ থাকলে পানি নীলাভ হয়ে যায়। কিন্তু প্রতিদিন শত শত নৌকা নদীর তলদেশ খুবলে খায়। আগের মতো পর্যটক আসে না।
প্রশাসনের তথ্যমতে, সারী ঘাট থেকে লালাখাল জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত বালু তোলার অনুমোদন দেয়নি প্রশাসন। এই বালুমহাল ইজারাও দেওয়া হয়নি।
সর্বদলীয় চক্র
সরেজমিন জানা গেছে, বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ করছেন বৃহত্তর সারী বারকি শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি, আওয়ামী লীগ কর্মী আমির আলী ও সাধারণ সম্পাদক নজির আহমদ, একই দলের চারিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান সামসুজ্জামান সেলিম, নিজ পাট ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রহিম উদ্দিন ও তাঁর ভাই তাজউদ্দিন, কামরাঙ্গি গ্রামের সিফত উল্লাহ কুটি, ময়না গ্রামের আব্দুল মন্নান, বালু ব্যবসায়ী ও বিএনপি কর্মী মাসুক আহমদ, বালু ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জামায়াত কর্মী আব্দুস সোবহান ওরফে সোবহান মোল্লা। তাদের নিযুক্ত শ্রমিকরা প্রতি নৌকার ট্রিপে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা ও প্রতি ট্রাক থেকে ২ হাজার টাকা আদায় করেন। নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে শ্রমিকরা সরাসরি টাকা উত্তোলনের পর দিন শেষে তা সংগ্রহ করেন সেলিম, রহিম ও কুটি।
দিনে ওঠে ১০ লাখ টাকা চাঁদা
বৃহত্তর সারী বারকি শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্যমতে, সারীসহ আশপাশের নদীতে কাজ করা শ্রমিকের সংখ্যা ৪ হাজারের ওপর। শুধু সারী নদীতে তাদের শ্রমিকের সংখ্যা হাজারখানেক। প্রতিদিন ৩-৪শ নৌকা কমপক্ষে তিনটি করে ট্রিপ দেয়। প্রতি ট্রিপে একটি নৌকা ১২০ থেকে ১৫০ ঘনফুট বালু বহন করে। ৪৫ টাকা ঘনফুট হিসাবে মহাজনের কাছে বালু বেচা হয়। গড়ে ৮০০ টাকা হিসাবে একহাজার ট্রিপে চাঁদা ওঠে প্রায় ৮ লাখ টাকা। শুধু সারী নদী নয়; রাংপানি নদীর বাংলাবাজার থেকে শ্রীপুর পাথর কোয়ারি পর্যন্ত বালুর পাশাপাশি তোলা হয় পাথর। সেখানে আরও শতাধিক নৌকা প্রতিদিন ১০-১৫ হাজার ঘনফুট পাথর ও লক্ষাধিক ঘনফুট বালু তোলে। সেখান থেকে একইভাবে ২ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, উত্তোলন করা চাঁদা থেকে সপ্তাহে উপজেলা প্রশাসন, বিজিবি ক্যাম্প ও থানা পুলিশকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। স্থানীয় কিছু গণমাধ্যম কর্মীও সপ্তাহে ৫-১০ হাজার টাকা পান। প্রতিদিন খরচ দেখানো হয় আরও ৫০ হাজার টাকা। বাকি টাকা নেতৃত্বে থাকা লোকজন ভাগ করে নেন। বিভিন্ন দপ্তর নিয়ন্ত্রণ করেন ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
লিখিত অভিযোগ
চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় কামরাঙ্গীখেল দক্ষিণের বাসিন্দা সাজু আহমদ। তিনি এতে শ্রমিকদের মারধরের অভিযোগ করেন। একই দিন এলাকাবাসীর পক্ষে আরেকটি অভিযোগ করা হয়।
নৌকা থেকে চাঁদাবাজি সংক্রান্ত ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করায় গত ২৮ ডিসেম্বর স্থানীয় সাংবাদিক নাজমুল ইসলামকে হাত কেটে নেওয়ার হুমকি দেন সারী ঘাট বারকি শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি আমির আলী। এ ঘটনায় থানায় জিডি করেন নাজমুল।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
এ বিষয়ে আমির আলী জানান, একশ টাকা করে শ্রমিক চাঁদা নেন। এর বাইরে কোনো টাকা নেওয়া হয় না। অনেকে মুখস্থ চালিয়ে দিচ্ছে। তিনি তাদের সংগঠনের আওতায় চার হাজারের ওপর শ্রমিক রয়েছে বলে জানান।
অবৈধ বালুমহাল নিয়ন্ত্রণের আরেক সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা রহিম উদ্দিন জানান, তারা ৪০ টাকা করে শ্রমিক চাঁদা নেন। দুই ইউনিয়ন পরিষদ কিছু টাকা পায়। শ্রমিকরা বিনামূল্যে বালু উত্তোলন করছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘চাঁদা আদায়ের বিষয়টি মিথ্যা।’
জৈন্তাপুর থানার ওসি আবুল বাসার মোহাম্মদ বদরুজ্জামান বলেছেন, ‘বালু বা পাথর উত্তোলন বন্ধের এখতিয়ার উপজেলা প্রশাসনের। পুলিশ তাদের সবসময় সহযোগিতা করে। আমি যোগদানের পর কেউ যাতে পুলিশের নামে টাকা না নিতে পারে, সে জন্য নজরদারি করা হচ্ছে। কেউ প্রমাণ দিতে পারলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
লালাখাল বিজিবি বিওপির কোম্পানি কমান্ডার শাহ আলম জানান, শূন্য রেখার বাইরে কেউ গেলে তারা সেটা দেখে থাকেন। দেশের মধ্যে নদী থেকে বালু, পাথর উত্তোলনের বিষয় দেখার দায়িত্ব তাদের নয়। বিজিবিকে ম্যানেজ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যারা এসব বলে, তারা প্রমাণ দিতে পারবে না। তাদের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। এ রকম হয়ে থাকলে তারা বিজিবির নাম ভাঙাচ্ছে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালিক রুমাইয়া সমকালকে বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসন নদী থেকে অবৈধভাবে বালু, পাথর উত্তোলনে বারবার অভিযান চালাচ্ছে। তারপরও রোধ করা যাচ্ছে না। প্রশাসনের নাম করে কেউ সুবিধা নিয়েছে, এমন তথ্যপ্রমাণ কেউ দিতে পারবে না।’ অভিযানের পর কেন বালু উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না– এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে এলাকার মানুষ সেটা করে আসছে। শুধু শ্রমিক নয়; সব পেশার মানুষ যতদিন না সচেতন হবে ততদিন সম্ভব হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রশাসনের এমন লোকবল নেই যে নদীতে বসিয়ে রাখবে। এটা রোধ করতে হলে বিকল্প কর্সংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।’
- বিষয় :
- পর্যটন