যাত্রীবাহী বাস খাটছে ভাড়ায় কর্মকর্তাদের পকেট ভারী

চট্টগ্রাম শহরে সকাল-সন্ধ্যায় বাস কম চলাচল করায় যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। অথচ দুপুর বেলায়ও ডিপোতে বসিয়ে রাখা হয়েছে বিআরটিসির বাস সমকাল
তৌফিকুল ইসলাম বাবর, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫ | ০০:১৪
পরিবহন সংকটে অসহনীয় ভোগান্তিতে চট্টগ্রামের মানুষ। সকাল ও সন্ধ্যায় বাস পেতে যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। শুধু তাই নয়, কর্মস্থল ও বাসাবাড়ি যেতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় তাদের। ঠাসাঠাসি করে যেতে হয় গন্তব্যে। ভাড়াও গুনতে হয় বেশি। এমন পরিবহন সংকট নিরসনে ভালো একটি উপায় হতে পারত বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন-বিআরটিসির বাসগুলো। কিন্তু এসব বাসের বড় একটি অংশ সাধারণ যাত্রী পরিবহনে ব্যবহৃত হচ্ছে না। গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিয়ে-পিকনিকে ভাড়ায় খাটছে। ফলে বিদ্যমান গণপরিবহন সংকট নিরসনে আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারছে না সরকারি বাস।
চট্টগ্রামে নিয়মবহির্ভূতভাবে বাস পরিচালনা করছে বিআরটিসি। এ বাসগুলো সংস্থারই চালক-হেলপারদের দৈনিক ভিত্তিতে ভাড়ায় দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ইচ্ছামতো গাড়িগুলো পরিচালনা করছেন তারা। এটা অনেকটা যে সংস্থায় চাকরি, সেই সংস্থার সঙ্গে ব্যবসা করার মতোই। চালকদের সঙ্গে থাকেন এলাকার প্রভাবশালী লোকজন এবং কতিপয় দালাল। রুটভিত্তিক এসব গাড়ি বণ্টনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে অর্থ লেনদেন হয়ে থাকে। তাছাড়া চালক-হেলপার থাকার পরও নিজেরাই গাড়ি পরিচালনা না করে দৈনিক ভিত্তিতে ভাড়ায় লাগিয়ে দেওয়ায় অনেকটা আরাম-আয়েশে সময় কাটে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। আবার পকেটও ভারী হয় তাদের।
বিআরটিসির নীতিমালা অনুযায়ী কোনো কারণে আয় বৃদ্ধি কিংবা লোকসান হ্রাসে স্বল্পমেয়াদে অপারেটর নিয়োগের মাধ্যমে গাড়ি ইজারা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু তা না করে খোদ বিআরটিসির চালক ও কিছু দালালের হাতে দৈনিক ভিত্তিতে গাড়ি তুলে দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
বিআরটিসির একাধিক চালক জানিয়েছেন, রুট ও গাড়িভিত্তিক বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ দিয়ে বাস নিতে হয়। দিনে প্রতি বাসের জন্য ‘অফিস খরচ’ হিসেবে এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। এ ছাড়া নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ দিতে হয় একশ্রেণির শ্রমিক নেতাদেরও। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন আর শ্রমিক নেতাদের সেই টাকা দিতে হচ্ছে না।
গত ১৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় সরেজমিন দেখা যায়, অফিসপাড়া হিসেবে পরিচিত বন্দর নগরীর বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ মোড়ে ঘরমুখো মানুষের ভিড়। চোখের সামনে দিয়ে একের পর এক চলে যাচ্ছে বাস-মিনিবাস। মাঝে মাঝে যাচ্ছে বিআরটিসির বাসও। কিন্তু এসব বাস-মিনিবাস যাত্রী ওঠানামা করছে না। দেখলে মনে হবে এগুলো ‘বিরতিহীন সার্ভিস’। হঠাৎ কোনো একটি বাস একটু থামলেই তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন সাধারণ যাত্রীরা। অনেক পুরুষ যাত্রী কোনোভাবে ঠাসাঠাসি করে বাসে উঠতে পারলেও বেশির ভাগ নারী যাত্রীকে হতাশ হতে হচ্ছে। পরে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তাদের। গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় ভাড়ায় চলাচলের কারণে সাধারণ যাত্রীরা এসব বাসের সুফল পাচ্ছে না। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই গাড়িগুলো ভাড়ায় খাটায় বিপাকে পড়তে হয় যাত্রীদের।
প্রতিদিন আগ্রাবাদ থেকে বহদ্দারহাট যাওয়া-আসা করেন ব্যাংক কর্মচারী নাছির উদ্দিন। রোববার সন্ধ্যায় আগ্রাবাদ মোড়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, বিআরটিসির বাসগুলো বিভিন্ন শিল্প-কারখানার সঙ্গে চুক্তি করে শ্রমিক-কর্মচারীদের আনা-নেওয়ায় ব্যস্ত থাকে। সাধারণ যাত্রীদের পরিবহন করে না। অথচ এসব বাস যদি নিয়মিত যাত্রী পরিবহন করত তাহলে নগরীতে গণপরিবহন সংকট কমে আসত।
চট্টগ্রাম বাস ডিপো সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে বিভিন্ন রুটে বিআরটিসির একতলা এবং দ্বিতল মিলে ৬৭টি যাত্রীবাহী বাস চলাচল করছে। এর বাইরে দুটি বাসকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। চলাচলরত বাসগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে ছয়টি, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে ১২টি, স্মার্ট স্কুল বাস হিসেবে চলে ১২টি এবং ছাদখোলা বাস দুটি। এ হিসেবে ৩২টি বাসই ব্যস্ত থাকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পরিবহনে এবং ছাদখোলা দুটি বাস চলে পর্যটকদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কাজে। নগরীর নতুন ব্রিজ হয়ে জেলার পটিয়া রুটে চলে ১০টি বাস, আনোয়ারা রুটে চারটি, চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটে দুটি, চট্টগ্রাম-কুমিল্লা কোম্পানীগঞ্জ রুটে একটি, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি রুটে চারটি, চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি রুটে চারটি, চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে দুটি এবং চট্টগ্রাম থেকে সিলেট হয়ে সুনামগঞ্জ রুটে চলে দুটি বাস। এর বাইরে কয়েকটি বাস শহরে চলাচল করে। রিজার্ভ ভাড়ার যাত্রীদের নামিয়ে সময় পাওয়া গেলে নগরীর সাধারণ যাত্রীদের পরিবহন করে কয়েকটি বাস। তবে পিক আওয়ারে এসব বাসে ওঠার সুযোগ পান না সাধারণ যাত্রীরা। সব মিলিয়ে বিআরটিসি বাস থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল সমকালকে বলেন, নগরীতে যাত্রীর অভাব নেই। তাই বিআরটিসির বাস চলাচল নিয়ে আমাদের তেমন কোনো ক্ষতি নেই। বরং নগরীর গণপরিবহনের সংকট নিরসনে আমরাও চাই বিআরটিসির বাসগুলো সাধারণ যাত্রী পরিবহন করুক। কিন্তু তারা সেটি না করে বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় ভাড়ায় লাগিয়ে দিচ্ছেন। কিছু গাড়ি নিজেদের চালকদের দৈনিকভিত্তিতে দিয়ে পরিচালনা করছে।
তবে এমন সব অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেছেন বিআরটিসি চট্টগ্রাম ডিপোর ম্যানেজার (অপারেশন) জুলফিকার আলী। তিনি বলেন, বিআরটিসি বাস বিভিন্ন গার্মেন্ট ও শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের পাশাপাশি সাধারণ যাত্রীদেরও পরিবহন করছে। নিউমার্কেট থেকে পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন রুটে কয়েকটি বাস নিয়মিত চলাচল করে।
- বিষয় :
- বাস ভাড়া