ঢাকা সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ঠিকাদারি কাজ বাটোয়ারায় এখনও ‘খালেক স্টাইল’

ঠিকাদারি কাজ বাটোয়ারায়  এখনও ‘খালেক স্টাইল’

.

হাসান হিমালয়, খুলনা

প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ | ০১:৫৫ | আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ | ১০:১২

বেনামে ঠিকাদারি আর অন্যকে কাজ দিয়ে কমিশন পকেটে তোলার ব্যাপারে বেশ পটু ছিলেন খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) অপসারিত মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেক। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিশেষ তদন্ত দল তাঁর অনিয়মের নাড়ি-নক্ষত্র খুঁজে বের করতে গত বৃহস্পতিবার থেকে মাঠে। মেয়রের চেয়ারে বসে গেল ১১ বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার কাজ ভাগবাটোয়ারা এবং বিপুল অঙ্কের টাকা কমিশন নেওয়ার প্রাথমিক তথ্যও পেয়েছে দুদক।

গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তালুকদার খালেক নিরুদ্দেশ। পরে তাঁকে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে কেসিসিতে নিয়োগ করা হয় প্রশাসক। তবে তালুকদার খালেকের দেখানো পথে এখনও চলছে ঠিকাদারি কাজের ভাগবাটোয়ারা আর কমিশন বাণিজ্য। কেসিসির প্রকৌশলীদের সহযোগিতায় ভাগাভাগির নাটাই এখন বিএনপি নেতাদের হাতে। গেল পাঁচ মাসে ৫৮ কোটি টাকার চারটি দরপত্র থেকে কয়েক কোটি টাকার কমিশন নড়াচড়া হয়েছে বলে অভিযোগ মিলেছে। তবে নথিপত্রে সবকিছু ঠিক থাকায় কমিশন বাণিজ্যের বিষয়টি ‘বায়বীয়’ থেকে যাচ্ছে।

২০১৭ সালে ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ইজিপি) পদ্ধতিতে দরপত্র নেওয়া শুরু করে কেসিসি। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) অনুযায়ী দরপত্রে ১০ শতাংশের নিচে দর দেওয়া যায় না। একাধিক ঠিকাদার সর্বনিম্ন দর দিলে বেশি কাজ পাওয়া ঠিকাদারই কাজটি পান। 

দেখা যেত, কাজের দর আগে থেকে ঠিকাদারকে সরবরাহ করা হতো। ফলে একাধিক ঠিকাদার সর্বনিম্ন দর দিতেন। তখন কে কাজ পাবেন, ঠিক করে দিতেন তালুকদার খালেক। সেই সময় কাজ পাওয়া ঠিকাদারের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে কমিশন আদায় করা হতো।

পছন্দের প্রতিষ্ঠান যদি কাজের সংখ্যায় পিছিয়ে থাকেন, তাহলে বেশি কাজ করা প্রতিষ্ঠানের নামেই দেওয়া হতো কার্যাদেশ। তবে কাজটি অন্যকে দিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতেন মেয়র। মেয়রের নির্দেশ অমান্য করার সাধ্য কারও ছিল না। অন্যের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে গত সাড়ে ১৫ বছরে কয়েকশ কোটি টাকার কাজ করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। 

কেসিসি সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পর ঠিকাদারি কাজ পেতে বিএনপি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, ছাত্র প্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তা পরিচয়ে তদবির আসতে থাকে। চাপ নিতে না পেরে গত পাঁচ মাসে ১৮টি দরপত্র বাতিল ও পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়। এত চাপের মধ্যেও জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পের চারটি এবং কভিড-১৯ রেসপন্স অ্যান্ড রিকভারি প্রকল্পের তিনটি প্যাকেজের কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের ৫৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা মূল্যের ওই চারটি কাজ পেতে আড়াই কোটি টাকা কমিশন দিতে হয়েছে। এর মধ্যে নগরীর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ওহাব সরণি খাল খনন, বাঁধাই ও সড়ক নির্মাণের ১৩ কোটি ৯১ লাখ টাকার কাজ পান মাহাবুব ব্রাদার্স ও নাদিম জেভি। সিদ্দিপাশা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নাসিম কবির ও বিএনপি নেতা মাহামুদ হাসান শান্ত কাজ পাওয়ার নেপথ্যে ছিলেন। পরে তাদের সঙ্গে অংশীদার হন দৌলতপুর থানা বিএনপির সদস্য সচিব ইমাম হোসেন।

খানজাহান আলী সড়কের পিটিআই মোড় থেকে রূপসা ঘাট পর্যন্ত ড্রেন নির্মাণ প্যাকেজে তিনটি দরপত্র জমা পড়ে। এখানেও ১৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা দিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হয় মাহাবুব ব্রাদার্স। মাহাবুবের নিবন্ধনে কাজটি পান মিজানুর রহমান টিটু ও শামীমুল ইসলাম নামে বিএনপির দুই ঠিকাদার। পরে নর্থ খাল, শেরেবাংলা সড়ক থেকে মেটেপোল পর্যন্ত ড্রেন নির্মাণে ১৩ কোটি ১৬ লাখ টাকার কাজটি পায় বেনজির কনস্ট্রাকশন জেভি। এ কাজটি করছেন হাজি বাড়ির সেলিমসহ কয়েকজন।

মজিদ সরণিতে ড্রেন ও ফুটপাত নির্মাণের ১১ কোটি ৮৭ লাখ টাকার কাজেও তিনটি প্রতিষ্ঠান একই দর দিয়েছিল। কাজটি পেয়ে যায় সাহিদ এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানের মালিক সাহিদুর রহমান নিজেই কাজটি করছেন। এ ছাড়া কভিড প্রকল্পে চিত্রালী মার্কেটসহ কয়েকটি সড়কের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। টাকার অঙ্কের ছোট এসব কাজে তেমন কমিশন দিতে হয়নি।

সূত্রটি জানায়, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের চারটি কাজেই কমিশন দিতে হয়েছে। কমিশন নিয়েছেন স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন নেতা। তবে কাজ পাওয়া ঠিকাদাররা সবাই কমিশন দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

বিএনপি নেতা নাসিম কবির বলেন, সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ায় কাজ পেয়েছি। কাউকে টাকা দেওয়া লাগবে কেন? ঠিকাদার সাহিদুর রহমান বলেন, নিয়ম অনুযায়ী কাজ পেয়েছি, কাউকে কমিশন দিতে হয়নি।

কেসিসির প্রধান প্রকৌশলী মশিউজ্জামান খান বলেন, নিয়ম মেনে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। কেউ অনিয়মের প্রমাণ করতে পারলে শাস্তি মাথা পেতে নেব।

আরও পড়ুন

×