‘নববর্ষে আসা মেয়েটি ঘুরিয়ে দিতে পারে ভাগ্যের চাকা’

ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী, চাঁদপুর
প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫ | ২৩:০৭ | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৫ | ০০:০৪
বৈশাখের প্রথম দিন। সন্তান আসবে ঘরে। কথাটি আগেই বলেছিলেন চিকিৎসক। এ জন্যই শাহাদাত হোসেন ও রিনা বেগমের মনে বাড়তি আনন্দ। তর সইছিল না যেন তাদের! হ্যাঁ, ঠিকই বৈশাখের নতুন সূর্য হয়ে তাদের কোল আলোকিত করে সন্তান।
চরম এক টানাপোড়েনের সংসারে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে তৃতীয় সন্তানের আগমনে তাদের খুশি বেড়ে যায় বহুগুণে। সকাল বেলায় তাদের মেয়ের মিষ্টিমুখটা দেখে চিকিৎসক এবং দু’জন নার্স কোলে নেওয়ার পর হাসপাতালের তালিকায় যখন নামটি দেবেন তখন তারা বলেন, ‘এই যে শুনেন মা-বাপ দু’জন। আজ বাংলা নববর্ষ এবং পহেলা বৈশাখ। তাই মেয়ের নামটি আমরা তালিকায় ‘বৈশাখী’ দিয়ে দিলাম। খুশি তো?’ শাহাদাত আর রিনা মাথা নেড়ে সায় দিলেন। তবে চিকিৎসক আবার সঙ্গে সঙ্গে একটু স্পষ্ট করে বলেন, ‘ইচ্ছা করলে আপনারা এই বিশেষ দিনের নামের সঙ্গে নিজেদের পছন্দের আরও নাম জুড়ে দিতে পারেন।’
নবজাতকের বাবা শাহাদাত হোসেন পেশায় রিকশাচালক। গত আট বছর ধরে অভাব-অনটনের তাড়নায় দুই ছেলে- পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রহমত আর ছোট ছেলে মাদ্রাসায় পড়ুয়া ইসমাইলকে নিয়ে চলে আসেন চাঁদপুর জেলা শহরের রহমতপুর কলোনিতে। এখানে একটা সেমিপাকা ছোট এক রুমের ভাড়া বাসা নেন। তার মূল বাড়ি ফরিদগঞ্জ উপজেলার সকদী রামপুর গ্রামে। স্ত্রী রিনার বাড়িও একই উপজেলার পাশের গ্রামে। শহরে এসে শাহাদাত রিকশা নিয়ে ভাড়ায় তা চালান। ৩০০ টাকা ভাড়া শোধ করেন আর এক-দেড়শ টাকায় চলে সংসার।
পহেলা বৈশাখে জন্ম নেওয়া মেয়েকে নিয়ে কথা হয় বাবা শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রাত ৩টায় স্ত্রী রিনার প্রসব ব্যথা ওঠে। ক্রমেই ব্যথা বাড়তে থাকলে একটা অটো ডেকে আমার এক ভাবিসহ বাসা থেকে আধা কিলোমিটার দূরে সরকারি মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে (যেটি মাতৃমঙ্গল নামে পরিচিত) নিয়া আসি। সঙ্গে সঙ্গেই দারোয়ান হাসপাতালের গেইট খুইলা দেয় এবং নার্স এসে আমার স্ত্রীকে বেডে দেয়। পরপরই ডিউটি ডাক্তার আসেন। তারা ভাবিকে বললেন, চিন্তা করবেন না, সবকিছু ঠিক আছে ইনশাআল্লাহ। উনার নরমাল ডেলিভারিই হবে এবং মায়ের গর্ভের সন্তান ভালো আছে।’
শাহাদাত বলেন, ‘আমি হাসপাতালের বাহিরে দাঁড়ানো থাকতে থাকতেই ভোর রাইত শেষ হইয়া চারদিক ফর্সা হইতাছে দেখতাছি। এক সময় ভেতর থেইকা দারোয়ান আইসা বলল– আসেন ভেতরে। আপনে মেয়ের বাপ হইছেন। তখন আল্লার কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। ডাক্তার এবং নার্স বলল, সকাল সাড়ে ৮টায় আমরা আপনার সন্তান প্রসব করিয়েছি। একটা স্যালাইন আর সামান্য কিছু ওষুধ শেষ হলেই ১০টার মধ্যেই বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডাক্তার ও নার্সরা প্রথমে আমার ভাবির কোলে দেয় আমার মেয়েকে। পরে তার মায়ের কাছে। এ সময় সন্তানটির পরনে ছিল একটা লুঙ্গি কাটা আর ছেঁড়া কাঁথা মোড়ানো। সকাল ১০টার একটু পরে একটা অটোরিকশায় বাসায় তাদের পাঠাইলেও আমি গেলাম না। কারণ আমি আমার একমাত্র মাইয়াডার লেইগা দুইডা পাতলা জামা, মশারি আর ওষুধ কিনার লাইগা কালীবাড়ি এলাকায় গেলাম। পরে কিন্না বাসায় ফিরা আইলাম।
‘একটা ভালো খবর হইলো কী জানেন স্যার, ফরিদগঞ্জের ডাক্তার পরেশ আর এই কেন্দ্রের ডাক্তাররা বলছে, আমার সন্তানের জন্ম হবে ১৪ এপ্রিল মানে বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ। একদম ঠিক ঠিক মেয়েটা সেই দিনই হইলো।’
মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের চিকিৎসক মেহেদী আল মাসুদ বলেন, ‘নববর্ষের প্রথম প্রহরের রোগীই রিনা। তার চিকিৎসার কোনোরূপ ত্রুটিই আমরা করিনি।’
২০১৩ সালে বিয়ে হয়েছে এই দম্পতির। অভাব-অনটনের সঙ্গেই তাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে।
শাহাদাত বলেন, ‘একটা ভালো কোনো কাজ পাইলে রিকশা চালানো ছাইরা দিতাম। অনেক কষ্ট হয়। দুই ছেলে সন্তানের পর নববর্ষে আসা মেয়েটি ঘুরিয়ে দিতে পারে ভাগ্যের চাকা। মেয়ে আমার সুস্থ থাক বাইচা থাক– এই দোয়া চাই সবার কাছে আর মা রিনাও যেন ভালো থাকে।’
- বিষয় :
- শিশু