চাঁদপুরে মেঘনায় আবারও ভেসে উঠছে মরা মাছ

চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে ভেসে ওঠা মরা মাছ। ছবি: সমকাল
চাঁদপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫ | ১৭:৪৩ | আপডেট: ১৭ মে ২০২৫ | ১৯:৫৫
বিষাক্ত বর্জ্য ও কেমিক্যালের কারণে পানি দূষণ বেড়ে যাওয়ায় চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে আবারও মরে ভেসে উঠছে দেশীয় মাছ। শুক্রবার জেলার মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে দশানি পর্যন্ত মেঘনা পাড়ের বিভিন্ন স্থানে মরা মাছ ভেসে থাকতে দেখা যায়।
এদিন মাছ ধরতে নদীতে নেমে জেলেরা দেখেন, পানিতে ভেসে রয়েছে অসংখ্য মরা মাছ। এর মধ্যে রয়েছে জাটকা, চেউয়া, বেলে, টেংরা, পুটি, চাপিলাসহ অসংখ্য ছোট-বড় দেশীয় মাছ।
অন্যদিকে পচা মাছের দুর্গন্ধে নদী পাড়ের বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। তারা জানান, দূষণ হওয়ার কারণে এখন নদীর পানি খাওয়া ও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কী কারণে বারবার মাছ মারা যাচ্ছে এবং পানি দূষণ হচ্ছে, তার সমাধান চান তারা।
দশানি এলাকার বাসিন্দারা জানান, বাচ্চারা নদীতে খেলতে যায়, গোসল করে। এখন তো মনে হচ্ছে পানিতে হাত দিলেও অসুস্থ হয়ে যাবে।
এদিকে জাটকা মরে ভেসে উঠায় চিন্তিত মেঘনার জেলেরা। তারা বলেন, এভাবে জাটকা মারা গেলে মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাওয়া যাবে না।
ষাটনল এলাকার জেলে পলাশ বর্মন বলেন, ‘কয়েক বছর ধরেই এমন হচ্ছে। কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। জাটকাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে মাছশূন্য হয়ে যাবে নদী।’
দশানি এলাকার মাছ ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যা দেখতেছি, তাতে আগামী দিনগুলায় নদী থেকে মাছ পাওয়া কঠিন হইবো।’
পার্শ্ববর্তী কলাকান্দা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. শামসুদ্দিন বলেন, ‘যেসব এলাকায় মাছ মরে যাচ্ছে, ওই এলাকা পরিদর্শন করেছি। নদীর এই অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক। মাছ মরার এই ঘটনা শুধু পরিবেশের ক্ষতি নয়, মানুষের জীবিকার ওপরেও সরাসরি আঘাত। প্রতিদিন শত শত মানুষ এই নদীর ওপর নির্ভরশীল।’
তিনি বলেন, ‘বারবার অভিযোগ করলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। আমি উপজেলা পরিষদে বিষয়টি তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছি এবং জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ পাঠাবো। নদী বাঁচলে আমরা বাঁচবো।’
মতলব উত্তর উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাস বলেন, ‘এটি নিছক মাছ মরার ঘটনা নয়, এটি একটি জলজ পরিবেশগত দুর্যোগ। শীতলক্ষ্যা থেকে আসা দূষিত পানির প্রবাহ একাধিকবার এই এলাকায় বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এটি প্রথম নয়, একাধিকবার ঘটেছে এমন ঘটনা।’
তিনি বলেন, ‘২০২৩ সালের মার্চ ও ২০২৪ সালের আগস্ট মাসেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। তখনও মেঘনার পানি দূষিত হয়ে মাছের মৃত্যু হয়। তবে এবার পরিমাণ আরও বেশি দেখা যাচ্ছে।’
ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান সমকালকে বলেন, শত শত কারখানার বর্জ্য এবং বিষাক্ত কেমিক্যাল বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা গড়িয়ে মেঘনা নদীর গভীর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। এসব থেকে নির্গত অ্যামোনিয়াম, ফসফরাস, কার্বনসহ নানা বিষাক্ত গ্যাস ইলিশ, জাটকা, অন্যান্য মাছ এবং জলজ প্রাণিদের বেঁচে থাকার জন্য হুমকি।
তিনি বলেন, এসবের প্রভাবে পানিতে যে পরিমাণ অক্সিজেন থাকার কথা তা কমে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের করা গবেষণার ফলাফল দিয়েছিলাম। বলেছি, এসবকে রুখতে যতরকম ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তা নেওয়া জরুরি। এখানে পরিবেশ অধিদপ্তরের বড় পদক্ষেপ প্রয়োজন।
পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠন ‘মতলবের মাটি ও মানুষ’ এর সভাপতি শামীম খান বলেন, ‘নদীকে কেন্দ্র করে হাজারো পরিবার মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। বারবার দূষণে নদী মৃতপ্রায়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। প্রয়োজন দ্রুত আন্তঃজেলা পরিবেশ কমিশন গঠন এবং কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘মাছ মরে যাওয়ার এই ঘটনায় শুধু পরিবেশ নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শত শত জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীরাও। নদীর ওপর নির্ভরশীল হাজারো মানুষের জীবিকাও এখন হুমকির মুখে।’
চাঁদপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, মেঘনা নদীতে মাছ মরে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে গত ৩০ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নদীর পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায়, পিএইচ ও অক্সিজেনের হার কমে গিয়েছিল। এছাড়া নদীর তলদেশ দিয়ে কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও ক্যামিক্যালযুক্ত পানি বয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, নতুন করে আবার কেন মাছ মারা যাচ্ছে, সেটি তদন্ত করে দেখতে হবে।
এদিকে শনিবার মতলব উত্তরের মেঘনার ওই এলাকা পরিদর্শন করেন চাঁদপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক। তিনি বলেন, আমরা নতুন করে আজ পানির সেম্পল সংগ্রহ করেছি। এই পানি চট্টগ্রাম আমাদের গবেষনায় পাঠাবো।