ঢাকা মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫

চরের তপ্ত বাতাসে দুর্ভোগ রাজশাহী নগরবাসীর

চরের তপ্ত বাতাসে দুর্ভোগ রাজশাহী নগরবাসীর

.

 সৌরভ হাবিব, রাজশাহী

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৫ | ০১:১৫ | আপডেট: ১৮ মে ২০২৫ | ০৭:২১

একসময় পদ্মার জলরাশি থেকে শীতল হাওয়া বইত চারদিকে। নদীর বুকজুড়ে এখন শুধুই বালুচর। শুষ্ক মৌসুমে তা থেকে ছড়ায় উত্তপ্ত বাতাস। এতে রাজশাহী নগরবাসীর জীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ।

পদ্মার পানির ওপর নির্ভর করে দেশের বিশাল অংশের কৃষি ও জীববৈচিত্র্য। বর্ষায় নদীতে পানি থাকলেও অন্য সময়ে থাকে শীর্ণ। নগরীর তালাইমারী, পঞ্চবটী, আলুপট্টি, কুমারপাড়া, ফুদকিপাড়া, বড়কুঠি, দরগাপাড়া, টি-বাঁধ এলাকায় জেগেছে বিশাল চর। শহর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূর দিয়ে বইছে নদীর মূলধারা। আলুপট্টি এলাকায় পদ্মাপারে গিয়ে দেখা গেল, চরে কাপড় শুকাতে দিয়েছেন ধোপারা। এর পাশেই কিশোররা ক্রিকেট খেলছে। নদীতীর থেকে এক কিলোমিটার হেঁটে গেলে মিলবে একটি চ্যানেল। এটি দিয়ে পানি বইছে গ্রামের ছোট নদীর মতো।

গবেষকরা বলছেন, ফারাক্কা থেকে যে পানি বাংলাদেশের পাওয়ার কথা, তা ভারত দিচ্ছে না। এতে সৃষ্ট সংকট থেকে রক্ষা পেতে নদীর পানি ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা জরুরি। গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প নেওয়া হলে সমস্যা কিছুটা কমবে। এ জন্য ভারতেরও এগিয়ে আসা প্রয়োজন। ফারাক্কা চুক্তিতে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার কথা থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে তা মেলে না। এ কারণে পদ্মা থাকে পানিশূন্য। ফারাক্কা পয়েন্টে কত পানি ছাড়ছে, এর কোনো তথ্য নেই। পাবনার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানি মাপা হয়। কিন্তু মাঝে মহানন্দার পানি পদ্মায় যুক্ত হচ্ছে। তাই ফারাক্কা থেকে কত পানি মিলছে, এর প্রকৃত হিসাব নেই। তবে এবার মহানন্দায় রাবার ড্যাম স্থাপন করায় শুষ্ক মৌসুমে পদ্মায় পানি আরও কমবে।

সম্প্রতি পদ্মার টি-বাঁধে বেড়াতে আসা রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী শাহরিন আফরোজ বলেন, নদীতে পানি থাকলে নগরীতে দক্ষিণের শীতল বাতাস প্রবেশ করে। এখন শুষ্ক মৌসুমে পানি নেই। এই বালুচর অল্পতেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এতে গরম বাতাস বয়ে চলায় জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। 

নগরীর আলুপট্টির পদ্মাপারের বাসিন্দা আইনজীবী মলয় কুমার ঘোষ বলেন, ছোটবেলায় পদ্মার উত্তাল রূপ দেখেছি। প্রচণ্ড গতিতে বয়ে চলত পানি। রাতে শোঁ শোঁ শব্দ ভয় ধরাত মনে। প্রচুর পানি থাকত সারাবছর। নদীতে নানা রকম মাছ পাওয়া যেত। এখনকার পদ্মার সঙ্গে ছোটবেলার পদ্মার কোনো মিল নেই। 

পদ্মাপারের বাসিন্দা দোকানি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ১৯৭০ সালে রাজশাহীতে এসেছি কিশোরগঞ্জ থেকে। তখন পদ্মার ভয়ংকর গর্জন ছিল। অথৈই পানি থাকত সারাবছর। বন্যায় প্রতিবছর শহর প্লাবিত হতো। এখন সেই পদ্মা নেই। ফারাক্কা বাঁধের কারণে নদী মরে গেছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারোয়ার জাহান সজল বলেন, প্রথমে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, ১৯৯৬ সালের পানিচুক্তি বা ১৯৭৪ সালের চুক্তি অনুযায়ী যে পরিমাণ পানি পাওয়ার কথা, আমরা তা ঠিকমতো পাচ্ছি কিনা? এর তদারকি খুব জরুরি ছিল। চুক্তির মূল কথা হলো, ফারাক্কা পয়েন্টে যে পানি থাকবে, তা ভাগাভাগি হবে। নদী অববাহিকার পুরো পানি ভাগাভাগি হচ্ছে না। কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু চুক্তি নদী অববাহিকার পুরো পানি নিয়ে। ভারত গঙ্গা অববাহিকার প্রচুর পানি তুলে নেয়। তাই ফারাক্কা পয়েন্টে পানি কমে যায়। চুক্তিতে বলা আছে, বাংলাদেশে পানি এ পয়েন্টে কখনোই একটা মাত্রার (লেভেল) নিচে নামবে না। তবে এই পানির সঙ্গে আমাদের মহানন্দার পানিও যুক্ত হচ্ছে। যদি আমরা ফারাক্কা পয়েন্টে পরিমাপ করতাম, তাহলে বোঝা যেত, ভারতের কাছে আমরা কতটুকু পানি পাচ্ছি। হার্ডিঞ্জ পয়েন্টে যে পানি মাপা হচ্ছে, সেখানে ফারাক্কার পানির সঙ্গে মহানন্দার পানিও যুক্ত থাকে। আবার মহানন্দা নদীতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের পাশে রাবার ড্যাম করা হয়েছে। সেটি এ বছর থেকে কার্যকর হবে। এতে মহানন্দা নদীর প্রবাহ আরও কমে যাবে। আরও একাধিক প্রকল্পের মাধ্যমে মহানন্দার পানি তুলে চাষাবাদ করা হবে। তাই শুকনো মৌসুমে তেমন পানি পদ্মায় যুক্ত হবে না।

এ সমস্যার সমাধান হিসেবে গবেষক অধ্যাপক সারোয়ার জাহান সজল বলেন, নদী ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা আমাদের জন্য জরুরি। এর সঙ্গে সঙ্গে পদ্মা নদীতে গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারলে আমাদের এ অঞ্চলের ও পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া অংশে যে পানিস্বল্পতা আছে, সেটিও দূর হবে। অতিরিক্ত পানি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত (ডাইভার্ট) করার জন্য তাদের জায়গা নেই, আবার আমাদেরও দিচ্ছে না। গঙ্গা ব্যারাজ করতে কোনো সমস্যা নেই। বিশ্বব্যাংক কিংবা জাইকার মতো বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে ভারতের সঙ্গে মিলে এ কাজ করলে দুই দেশের উপকার হবে। বর্ষার সময় যে পানি আসবে, তা আমরা ধরে রাখতে পারব। এতে সব সময় দুই দেশের মানুষ কৃষিকাজে লাভবান হবে।

তবে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান অঙ্কুর বলেন, ফারাক্কা আন্তর্জাতিক চুক্তি। এই চুক্তিতে যে পানি পাওয়ার কথা, সেটি পাওয়া যায়। কিন্তু ফারাক্কার বাঁধে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। 

আরও পড়ুন

×