ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

করমজল কুমির প্রজনন কেন্দ্র

চালক হাতুড়েরাই

চালক হাতুড়েরাই

সুন্দরবনের করমজল প্রজনন কেন্দ্রের পুকুরপাড়ে দুটি বড় কুমির-সমকাল

মনিরুল হায়দার ইকবাল মোংলা (বাগেরহাট)

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২০ | ১৪:৫৭

দেশের একমাত্র সরকারি কুমির প্রজনন কেন্দ্রে তিন বছর ধরে কোনো বাচ্চা ফুটছে না। ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে এই কেন্দ্রের মা কুমির পিলপিল ও জুলিয়েটের ডিম থেকে একটিও বাচ্চা ফোটেনি। পাঁচ বছর ধরে এখানে নেই কোনো কুমির অথবা প্রাণী প্রশিক্ষণ ছাড়াই ধারণার ওপর ভরসা রেখে কাজ করছেন বনরক্ষীরা। চিকিৎসাও দেন তারা।

২০০২ সালে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল পর্যটন কেন্দ্রে ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে আট একর জায়গায় বন বিভাগের উদ্যোগে দেশের একমাত্র সরকারি কুমির প্রজনন কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়। প্রথমে জেলেদের জালে আটক ছোট-বড় পাঁচটি কুমির দিয়ে শুরু হয় কেন্দ্রের প্রজনন কার্যক্রম। এদের মধ্য থেকে প্রজননে সক্ষম দুটি স্ত্রী কুমির ও একটি পুরুষ কুমিরকে বাছাই করা হয়। স্ত্রী কুমির দুটির নাম রাখা হয় জুলিয়েট (৩৫) ও পিলপিল (২৮) এবং পুরুষ কুমিরটির নাম দেওয়া হয় রোমিও (৩৫)। আর এরা ওই নামেই দর্শনার্থীদের কাছে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠে।

২০০৫ সালে প্রথম জুলিয়েট ও পিলপিল ডিম দেয় এবং তাদের ডিম থেকে ফোটে বাচ্চা। এরপর কয়েক দফায় পিলিপিল ও জুলিয়েট ডিম দেয় এবং তা থেকে কমবেশি বাচ্চাও ফোটে। একপর্যায়ে ডিম থেকে নতুন বাচ্চা ফোটা কমে যাওয়ায় প্রজনন কেন্দ্রটির ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা শঙ্কা দেখা দেয়।

প্রজননে অক্ষম হয়ে ওঠায় ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক থেকে প্রজনন কেন্দ্রের প্যানে আরেকটি পুরুষ কুমির আনা হয়। এটির নাম দেওয়া হয় আলেকজান্ডার। বয়স প্রায় ৩৫ বছর।

এরপরও ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালেও মা কুমির জুলিয়েট ও পিলপিল থেকে কোনো বাচ্চা ফোটেনি। চলতি বছর ১২ জুন প্রজনন কেন্দ্রে ৪৪টি ডিম দেয় কুমির পিলপিল। এর মধ্যে কুমিরটির বাসায় ২১টি রেখে বাকিগুলোর মধ্যে ১২টি নতুন ইনকিউবেটর আর ১১টি পুরোনো ইনকিউবেটরে বাচ্চা ফোটানোর জন্য সংরক্ষণ করা হয়। নির্দিষ্ট সময় পর কেন্দ্রের নতুন ইনকিউবেটরে রাখা ১১টির মধ্যে চারটি ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হয়। বাকি ডিমগুলো নষ্ট হয়ে যায়।

করমজল বন্যপ্রাণী (কুমির) প্রজনন কেন্দ্রের ইনচার্জ আজাদ কবির জানান, তিন বছর ধরে এ প্রজনন কেন্দ্রে জুলিয়েট ও পিলপিলের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটছে না। তিনি বলেন, প্রজনন কেন্দ্রের পুরুষ কুমির রোমিও অতিরিক্ত মোটা ও বয়স বেড়ে যাওয়ায় প্রজনন সক্ষমতা হারিয়েছে। এ কারণে তাকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ওই অবস্থানে দেওয়া হয়েছে আরেক পুরুষ কুমিরকে। এটিকে দিয়ে এবার বাচ্চা ফোটানো হয়।

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে কয়েক দফায় ৭১টি কুমির বাচ্চা হারিয়ে যায় এবং বনবিড়ালের আক্রমণে মারা যায়। ২০০৯ সালে আইলার জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় ৩৮টি কুমির ছানা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় আরও ১৭টি কুমির বাচ্চা হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া রোগাক্রান্ত হয়েও কুমির ছানা মারাও যাচ্ছে।

ইনকিউবেটরে রাখা ১১টি ডিমের মাত্র ৪টি থেকে বাচ্চা ফুটেছে। বাকিগুলো নষ্ট। শনিবারের ছবি- সমকাল

সংশ্নিষ্টরা জানান, প্রজনন কেন্দ্রটির যাত্রার শুরুতেই দুই বন কর্মকর্তাকে অস্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে বন বিভাগ। এদের মধ্যে আবদুর রব নামের একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি অবসরে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এই কেন্দ্রের কোনো কুমির অথবা প্রাণী বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বন বিভাগের একজন স্টাফ দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চলছে এই কুমির প্রজনন কেন্দ্রটি। করমজল প্রজনন কেন্দ্রটি বনের পশুপাখির হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহূত হলেও কুমিরসহ বন্যপ্রাণীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামও নেই। এ কারণে করমজল কুমির প্রজনন কেন্দ্রে কুমির বিষয়ে প্রশিক্ষণ ছাড়াই ধারণার ওপর ভরসা রেখে কাজ করছেন বনরক্ষীরা। ধারণার ওপর নির্ভর করেই এখানে সাপ, হরিণ, বানর, বেজি, গুইসাপসহ আহত ও অসুস্থ সব প্রাণীর চিকিৎসা দেওয়া হয়।

বর্তমানে জুলিয়েট ও পিলপিলের ডিম থেকে ফোটা বাচ্চা থেকে এখন পর্যন্ত প্রজনন কেন্দ্রের ছোট-বড় মোট কুমিরের সংখ্যা ১৯৬টি। এর মধ্যে বড় মা কুমির দুটি ও পুরুষ কুমির চারটি। এদের মধ্যে প্রজনন কেন্দ্রের পুকুর মা দুটিসহ তিনটি এবং প্যানে তিনটি পুরুষ কুমির পালন হচ্ছে। এ ছাড়া এ পর্যন্ত ১৯৬টি কুমিরের ছানাকে সুন্দরবনের নদীতে অবমুক্ত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে এ কেন্দ্র থেকে ৯০টি কুমির ছানা ও ১০টি কচ্ছপ সুন্দরবনে অবমুক্ত করার কথা রয়েছে।

আজাদ কবির বলেন, 'চলতি মৌসুমে অতিবৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে প্রজনন কেন্দ্র প্লাবিত হওয়ায় ডিমসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী ও স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গত বছরও পিলপিল ৪৮টি ডিম দেয়, কিন্তু তা থেকে একটিও বাচ্চা ফোটেনি। পিলপিলের ডিম থেকে গত তিন বছর কোনো বাচ্চা ফোটানো সম্ভব হয়নি।

'২০২০ সালে পিলপিল ৪৪টি ও জুলিয়েট ৫২টি ডিম দেয়। এর মধ্যে পিলপিলের চারটি বাচ্চা হলেও জুলিয়েটের ডিম থেকে কোনো বাচ্চা ফোটানো সম্ভব হয়নি। ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে পিলপিল ও জুলিয়েটের ডিম থেকে একটিও বাচ্চা ফোটেনি,' বলেন আজাদ কবির।

এ সমস্যার জন্য যথাসময়ে সঠিক তাপমাত্রা না পাওয়া ও কেন্দ্রের ইনকিউবেটরের ত্রুটিকেই দায়ী করছেন প্রজনন কেন্দ্রের ওই কর্মকর্তা।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন জানান, এখানে বর্তমানে যে পুরোনো ইনকিউবেটর আছে, সেগুলো অনেক পুরোনো। নতুন যে ইনকিউবেটর তৈরি করা হয়েছে, তার ধারণক্ষমতা মাত্র ২৪টির। এ ধরনের আরও কয়েকটি নতুন ইনকিউবেটর তৈরি করা গেলে প্রজননে সক্ষমতা আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

আরও পড়ুন

×